Skip to main content
শারদীয়ার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন , করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ঘরে থাকুন , সুস্থ থাকুন -------- STAY HOME STAY SAFE protect your family

ভাওয়াল রাজ সন্ন্যাসী মামলা


বিংশ শতকের প্রথমদিকের একটি বিখ্যাত মামলা "ভাওয়াল রাজ সন্ন্যাসী মামলা "যা ফরেনসিক বিজ্ঞানে ও অনেক গুরুত্ব বহন করে।
গাজীপুর জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে কালের সাক্ষী হয়ে প্রায় অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক ভাওয়াল রাজবাড়ি। ভাওয়ালের রাজবাড়ি ছিল ভাওয়াল এস্টেটের মূল পরিচালনা কেন্দ্র। পরিধি এবং আয়ের দিক থেকে পূর্ব বাংলার নওয়াব এস্টেটের পরেই ছিল ভাওয়াল এস্টেটের জমিদারির অবস্থান। আয়তন এবং কক্ষের হিসেবে এটি একটি বিশাল আকারের রাজবাড়ি। প্রায় ৫ একর জায়গার ওপর রাজবাড়িটি নির্মিত। এ রাজবাড়ির পশ্চিম পাশে রয়েছে বিশাল একটি দীঘি এবং সামনে রয়েছে বিশাল সমতল একটি মাঠ।
এই রাজবাড়ীর আওতায় ভাওয়াল এস্টেট প্রায় ৫৭৯ বর্গমাইল (১,৫০০ কিমি) এলাকা জুড়ে ছিল। সম্পূর্ণ জমিদারিটি কয়েকটি সার্কেলে বিভক্ত ছিল। বর্তমানে ভাওয়াল এস্টেটের কর্মকাণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি সংস্কার বোর্ড পরিচালনা করে।
মূল প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে একেবারে পেছনে যেতে হলে হাঁটতে হবে অনেকটা পথ, পেরুতে হবে অনেক অলিন্দ আর বারান্দা। ক্ষণে ক্ষণে চোখ আটকে যাবে বিভিন্ন স্থাপত্য নিদর্শনে। বিশাল এ রাজপ্রাসাদটির বিশালত্ব দেখে যে কেউ অভিভূত হবেন। আবার অনেকেই রাজবাড়িতে ঢুকে গোলক ধাঁধায় পড়ে যেতে পারেন। কারণ এর অলিন্দ গলি উপগলি দিয়ে একবার হেঁটে গিয়ে নতুন যে কারোর পক্ষে পুনরায় সেগুলো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়বে। এ রাজবাড়ির প্রতিটি স্থানে প্রতিটি কক্ষে ঘুরে দেখতে সারা দিন লেগে যেতে পারে।
বিংশ শতকের প্রথম দিকে একটি বিশ্ব বিখ্যাত মামলা হয়েছিল। এটি ভাওয়ালের জমিদার বংশের রাজকুমার রমেন্দ্রনারায়ণ রায়কে ঘিরে। এ ঘটনা থেকে কবিতা, উপন্যাস, যাত্রাপালা, এমনকি চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছিল।
ভাওয়াল পরগনা এক সময় শাসন করতেন গাজী বংশের শাসকরা। ১৭৩৬ সালে গাজী বংশের শাসক দৌলত গাজী পদব্রজে হজব্রত পালন করতে গিয়ে মারা যান। এরপর তার দেওয়ান বলরাম রায় শঠতার আশ্রয় নিয়ে জমিদারী নিলামে তোলেন। ১৭৩৮ সালে নিজ নামে জমিদারী বন্দোবস্ত নেন। অবসান ঘটে গাজীবংশের জমিদারীর এবং শুরু হয় হিন্দু রাজাদের শাসনামল।
তখন থেকে বলরাম রায়ের পরিবারের সদস্যরা পর্যায়ক্রমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এই জমিদারির অধিকারী ছিলেন। ওই বংশের জমিদার লোক নারায়ণ রায় ভাওয়ালের রাজবাড়িটি নির্মাণ কাজ শুরু করেন। লোক নারায়ণ রায় বাড়িটির নির্মাণ শুরু করলেও শেষ করেন রাজা কালী নারায়ণ রায়।
কালী নারায়ণের পুত্র রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এই জমিদারির আরো বিস্তৃতি ঘটান। এই সময় ভাওয়ালের জমিদারি ঢাকা, ময়নসিংহ সহ বিভিন্ন জেলায় বিস্তৃত হয়ে পড়ে। এস্টেটের মৌজা সংখ্যা ছিল ২,২৭৪টি। জমির পরিমাণ ছিল ৪৫,৯১৬.৩০ একর। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বনভূমি ছিল।


রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর ছিল তিন পুত্রসন্তান। তারা হলেন রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী, রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী এবং রবীন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। ১৯০১ সালে রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর মৃত্যু হয়। এই সময় তার তিনপুত্রই ছিলেন নাবালক। সে কারণে জমিদারী বেঙ্গল গভর্মেন্ট ভাওয়াল এস্টেটের অধীনে চলে যায়। পরে রানী বিলাস মনি এর বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে রিট করেন। রানীর পক্ষে রায় দেন আদালত।
১৯০৭ সালে রানী বিলাস মনি মারা যান। এর আগে তিনি তার মধ্যম পুত্র রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর নিকট জমিদারী অর্পণ করেন। যিনি ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজা হিসেবে অধিক পরিচিত। সে সময়ে এই রাজার সাথে এক চমকপ্রদ ঘটনা ঘটে।
চিকিৎসার প্রয়োজন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি পারিবারিক সিদ্ধান্তে ভারতের দার্জিলিং যান। সঙ্গী হন ২০ বছরের স্ত্রী (মেজ রানী) বিভাবতী দেবী, বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাস গুপ্ত এবং ব্যক্তিগত কর্মচারি মিলে ২৭ জন। দলবল নিয়ে ২৫ এপ্রিল মেজকুমার দার্জিলিং পৌঁছেন।
দার্জিলিং যাওয়ার মাত্র ১৫ দিন আগে মেজকুমার সালনা কাছারির কাছে জোলারপাড় জঙ্গলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করে একটি ছবি তুলেছিলেন। এ ছবিটিই টাইগার ফটো নামে পরিচিত। এ ছবিটি উনবিংশ শতাব্দীর একটি অন্যতম ছবি হিসেবে বাংলাদেশ আর্কাইভস প্রদর্শনীতে স্থান পায়।
মে মাসের শুরুতে মেজ কুমারের পেটে ব্যথাসহ নানা শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। প্রতিদিন দার্জিলিং থেকে জয়দেবপুরে তার বার্তার মাধ্যমে রাজার স্বাস্থ্যের খবর পাঠানো হতো। প্রথম টেলিগ্রামে রাজার ৯৯ ডিগ্রি জ্বর, পরের টেলিগ্রামে জ্বর বৃদ্ধি, পেটে যন্ত্রণা, দার্জিলিং সিভিল সার্জন দেখে গেছেন ইত্যাদি খবর আসতে থাকে। ৭ মে সন্ধ্যা থেকে কুমারের অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে। ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও বমি, রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হতে থাকে।
৮ মে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে কোনো এক সময় রাজার মৃত্যু হয়েছে, বলা হয়। দার্জিলিংয়ের শ্মশানে তড়িঘড়ি করে শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয় বলে জানানো হয়। ১০ মে মেজরানী ও অন্যরা জয়দেবপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ১৮ মে মেজ কুমারের শ্রাদ্ধ করা হয়।
গতানুগতিকভাবে এ কাহিনী এখানেই শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু ভাওয়ালের এ রাজার জীবন-মৃত্যুর কাহিনীর এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেনি।
শ্রাদ্ধর দিনই গুঞ্জন ওঠে মেজকুমারের দেহের নাকি সৎকার হয়নি। ওই দিন শ্মশান ঘাটে মেজকুমারের লাশ নেওয়ার পর শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। এর মধ্যে লাশ ফেলে লোকজন শ্মশান ঘাট থেকে অন্যত্র আশ্রয় নেন। বৃষ্টির পর শ্মশানে গিয়ে তারা আর লাশটি দেখতে পাননি।
এর ১২ বছর পর ১৯২১ সালের ৪ মে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে আত্মপ্রকাশ ঘটে গেরুয়া বসন পরা এক সন্ন্যাসীর। দেখতে অবিকল মেজ কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরির মতো। এক কান-দু’কান হয়ে খবরটি জয়দেবপুর ও কাশিমপুরে জমিদার বাড়িতে পৌঁছে।
কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরি সন্ন্যাসীকে তার জমিদারিতে নিয়ে আসেন। আগন্তুকের গেরুয়া বেশ আর মুখভর্তি দাড়ি থাকলেও তারা নিশ্চিত এ-ই তাদের ‘মৃত’ মেজ কুমার। লোকজন আহ্লাদ ভরে সন্ন্যাসীর হাত-পা মুখ ছুঁয়ে দেখেন।
সন্ন্যাসী কাশিমপুরে কয়েকদিন থেকে দলবল নিয়ে রাজবাড়ির অদূরে মাধব বাড়িতে ওঠেন। এখানে এসে দেখা করেন মেজকুমারের বোন জোতির্ময়ী দেবী। প্রথম দেখাতেই জ্যোতির্ময়ীর চোখ আটকে যায়। এ তো তার ভাইয়েরই প্রতিচ্ছবি। তিনি সন্ন্যাসীকে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যান। সেই হাত, পা, নাক, মুখ, গায়ের রঙ, গলার স্বর, পায়ের ক্ষত!
জ্যোতির্ময়ী লক্ষ করেন তার ভাইয়ের মতো সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনি আলগা হয়ে যায়, জিহ্বা সামনে বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ী ভাইয়ের আগের একটি ছবি সন্ন্যাসীর সামনে এনে ধরেন। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে।
উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন ও কৌতূহলি লোকজন সন্ন্যাসীর পরিচয় নিশ্চিত হতে রীতিমতো পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। জমিদার পারিবারের খুঁটিনাটি বিষয়- তার বাবার নাম, মায়ের নাম, এমনকি যে দাইমার কাছে মেজকুমার বড় হয়েছেন তার নাম পরিচয় কিছুই বাদ যায়নি। সন্ন্যাসী পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হন। দিন দিন সন্ন্যাসীকে ঘিরে লোকজনের কৌতূহল ও চাপ বাড়তে থাকে। ডালপালা মেলতে থাকে নানামুখি গুজবের।
যাকে নিয়ে এত চাঞ্চল্য সেই সন্ন্যাসীর মুখ থেকে কথা বের হয় কমই। নিজ পরিচয় প্রশ্নে তিনি প্রচণ্ড রকম নির্লিপ্ততা দেখান। লোকজনের কৌতূহল প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। অনেকটা পেরেশান হয়ে অন্য সন্ন্যাসীদের নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ তীর্থে চলে যান। কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে আসেন ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে। কিন্তু লোকজনের উৎসাহে ভাটা পড়ে না।
কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরি সন্ন্যাসীকে পুনরায় তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে হাতিযোগে সন্ন্যাসীকে নিয়ে ছোটেন জয়দেবপুরের রাজবাড়ির দিকে। তাদের বহরের পিছু নেয় উৎসাহী জনতা। জয়দেবপুর পর্যন্ত আসতে আসতে কাফেলা রীতিমতো জনস্রোতে রূপ নেয়।
রাজবাড়ির সামনে কামিনী গাছের নিচে বসেন সন্ন্যাসী। হাজারো লোকের কৌতূহল তাকে ঘিরে। সমবেত লোকজনের সামনে রাজবাড়ির চিকিৎসক আশুতোষ দাস গুপ্ত সন্ন্যাসীকে তাদের দার্জিলিং অবস্থানকালীন একটি ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সঠিক জবাব দিয়ে সন্ন্যাসী তার দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ দেন।
প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজকুমারকে মেনে নেওয়া গুটিকয়েক লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম কুমারের স্ত্রী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি।
কারণ, তিনি ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া মেজকুমারের স্ত্রী হিসাবে বিভাবতী জমিদারির পক্ষ থেকে বাৎসরিক লক্ষাধিক টাকার যে ভাতা পেতেন তার পুরোটাই গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই মেজকুমারের ফেরা সত্যেন্দ্রর জন্য হলো অশনি সংকেত।
ভাইয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়াটা বিভাবতীর জন্য অসম্ভব ছিল। এর কিছুটা আভাস পাওয়া যায় বিভাবতীর কথায়। মেজকুমারের কথিত মৃত্যুর তিনদিন পর ১১ মে মেজরানীকে নিয়ে সত্যবাবু জয়দেবপুর পৌঁছেন। এরপর সত্যবাবু একবার বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে বিভাবতী মুখ ফিরিয়ে বলে ওঠেন, ‘দাদা তুমি আমারে রানী করেছিলে, আবার তুমিই আমাকে ভিখারিনী করলে।’
মেজকুমারের দার্জিলিংয়ে কথিত মৃত্যুবরণ করার ৮ বছর আগে বাবা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি ও দুই বছর আগে মা বিলাস মণি মারা যান। বড় ভাই রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরি মারা যান মেজকুমারের দার্জিলিং থেকে অন্তর্ধানের এক বছর পরে।
সন্ন্যাসীর আবির্ভাবের সময় জমিদারবাড়ির উত্তরসূরির মধ্যে শুধু ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায় বেঁচে ছিলেন। তিনি সন্ন্যাসীর পরিচয় নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে নিরবতা পালন করেন।
সত্যেন্দ্র উঠেপড়ে লাগলেন সন্ন্যাসীকে ‘প্রতারক’ প্রমাণ করতে। তিনি ছুটলেন দার্জিলিং। মেজকুমারের মৃত্যু সনদ ও কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে ঢাকা এসে কালেক্টর জে এইচ লিন্ডসের সঙ্গে দেখা করে সন্ন্যাসীকে ‘প্রতারক’ ঘোষণার দাবি জানান। কালেক্টর অনেকটা প্রভাবিত হয়ে সন্ন্যাসীকে প্রতারক উল্লেখ করে নোটিশ জারি করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নোটিশের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
নোটিশ জারি করার সময় কালিয়াকৈরের কাছে মির্জাপুরে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান জুনুব আলী নামের এক প্রজা। এ সময় প্রজারা রাজস্ব আদায়ের রশিদে মেজকুমারের নাম লিপিবদ্ধ করার দাবি জানান। এক পর্যায়ে প্রজারা খাজনা দিতে অস্বীকার করেন।
এদিকে মেজকুমারের ক্ষুব্ধ সমর্থকরা জয়দেবপুরে তখন ‘ভাওয়াল তালুকদার ও প্রজা সমিতি’ গঠন করেন। হারবাইদের জমিদার দিগিন্দ্র নারায়ণ ঘোষ সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ সময় জয়দেবপুরে সন্ন্যাসীকে নিয়ে ১৫ মে বিরাট জনসভা করে জনতা। রাজবাড়ি মাঠে ওই জনসভায় অন্তত দশ হাজার নারী-পুরুষ সমবেত হন।
সেদিন পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, রেল কোম্পানিকে স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল এবং বাজারে চিড়ার দর বেড়েছিল কয়েক গুণ।
কাপাসিয়ার বারিষাব জমিদারির বড় তালুকদার আদিনাথ চক্রবর্তী জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। সেদিন সাধারণ মানুষ নিজেরা চাঁদা দিয়ে তহবিল গঠন করেন। পথনাটক, যাত্রাপালা, পুঁথিপাঠ, জারিগান করে, গল্প-বুলেটিন-পত্রিকা ছেপে ব্যাপক জনমত তৈরি করেন। অপরপক্ষও বসে নেই। তারা ‘ভাওয়ালে ভূতের কাণ্ড’ নামে বই ছেপে দেন।
১৯২২ সালে মেজকুমারের ঠাকুর মা রানী সত্যভামা দেবী মেজ কুমারের সঙ্গে ঢাকায় বাস করতে লাগলেন। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর সত্যভামা দেবী মারা গেলে সন্ন্যাসীই তার মুখাগ্নি করেন।
১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে কলকাতার ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জীর একটি বাড়িতে অবস্থানকালে বড়রানী (মেজকুমারের বড় ভাই রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরির স্ত্রী) সূর্যবালা দেবী সন্ন্যাসীকে দেবর বলে চিনতে পারেন। এ ছাড়া মেজরানীর কয়েকজন আত্মীয়ও মেজ কুমারকে চিনতে পারেন এবং তার পক্ষে সাক্ষ্য দেন।
আইনজীবী ও স্থানীয় জমিদারদের নিয়ে সন্ন্যাসী সশরীরে ঢাকা বোর্ড অব রেভিনিউতে হাজির হয়ে তার পরিচয় উদঘাটনের জন্য ১৯২৬ সালের ৮ ডিসেম্বর আবেদন জানান। কিন্তু তা অগ্রাহ্য হয়।
আবেদনে সন্ন্যাসী উল্লেখ করেন, দার্জিলিংয়ে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললে সহযাত্রীরা ভাবেন তিনি মরে গেছেন। দুর্যোগপূর্ণ সেই রাতে স্থানীয় শ্মশানে লাশের সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে শবযাত্রীরা লাশ ফেলে চলে আসেন।
পরে স্থানীয় নাগা সন্ন্যাসীরা তাকে তুলে নিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। এ বছরগুলোতে তিনি সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হয়ে নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জমিদারির বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। কিন্তু কিছু স্বার্থপর লোক তাকে প্রতারক প্রমাণে সচেষ্ট থাকায় এখন পরিচয় প্রকাশের প্রয়োজন পড়েছে। কর্তৃপক্ষ এ আবেদনেও কর্ণপাত না করায় ১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অতিরিক্ত জজ আদালতে নিজের স্বীকৃতি ও জমিদারির অংশ দাবি করে মামলা করেন সন্ন্যাসী।
মামলার শুরুতেই প্রতিপক্ষের মূল ব্যক্তি সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি দার্জিলিং সিভিল সার্জনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মেজকুমারের মৃত্যু সনদ আদালতে দাখিল করেন। এছাড়া দার্জিলিং আবহাওয়া অফিস থেকে মেজকুমারের মৃত্যুর দিনের আবহাওয়ার রিপোর্ট সংগ্রহ করে আদালতে জমা দেন। এর মাধ্যমে সত্যেন্দ্রনাথ প্রমাণের চেষ্টা করেন কুমারের মৃত্যু দিনের আবহাওয়া স্বাভাবিক ছিল।
এ রিপোর্ট আদালতে সাময়িক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও পরে প্রমাণ হয় রিপোর্ট সংগ্রহের ক্ষেত্রে তঞ্চকতা করা হয়েছে। আবহাওয়া অফিসে রক্ষিত তথ্যপত্রে কাটা-ছেঁড়া করা হয়। দীর্ঘ ছয় বছর দু’পক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণ চলে।
পরে বিচারক পান্নালাল বসু ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট ৫৩২ পৃষ্ঠার রায় দেন। উভয় পক্ষে সাক্ষ্য দেন ১,৫৪৮ জন। এর মধ্যে বাদী পক্ষে ১,০৬৯ জন। প্রমাণ হয় আলোচিত সন্ন্যাসীই ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়।
এ রায়ের পর জয়দেবপুরের রাজবাড়ি মাঠে বিশাল একটি রাজভোগের আয়োজন করেন রাজা। হাজার হাজার লোক জমায়েত হন মাঠে। কিন্ত খাবার দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কিছু সন্ত্রাসী লাঠি হাতে ‘ধর, ধর’ বলে ধাওয়া করে। রাজা নিষ্পলক দৃষ্টিতে হাতির পিঠে বসে থাকেন। এ ঘটনার পর তিনি কলকাতায় চলে যান।
বিবাদিপক্ষ কোলকাতা হাইকোর্টে রায় চ্যালেঞ্জ করে আপিল করে। ১৯৪০ সালের ২৯ আগস্ট বিচারপতি লিওনার্ড ক্যাস্টেলো আগের রায়ই বহাল রেখে আদেশ দেন। আপিলে হেরে বিবাদিপক্ষ লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে পুনরায় আপিল করেন। যদিও লাভ হয়নি। ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই প্রিভি কাউন্সিল যে রায় দেন তাতে তা রাজার অনুকূলেই যায়।
ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, ভারতবর্ষের বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে এটি দিল্লিতে গত শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ মামলা হিসেবে স্থান পেয়েছিল।
মামলাটি শুরু হয় ১৯৩০ সালে আর শেষ হয় ১৯৪৬ সালে। আদালতে প্রকাশ্যে বিচারকার্য শুরু হয় ১৯৩৩ সালের ২৭ নভেম্বর। ১৯৩৬ সালের ২১ মে পর্যন্ত শুনানি চলে। সেখানে উভয় পক্ষের ১,৫৪৮ জন সাক্ষ্য দেন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েক জনের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য বিলেতেও কমিশন বসে। মামলা চলার সময় ঢাকার চারটি পত্রিকা বিবরণী প্রকাশ করত এবং ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা বিকেলে বিশেষ সংস্করণ বের করত।
প্রিভিয়ার্স কাউন্সিলের রায়ের পর মাত্র তিনদিন বেঁচে ছিলেন মেজকুমার। যেন মামলার চূড়ান্ত রায়ের জন্যই তার অপেক্ষা ছিল। কারণ, এই রায়ের সঙ্গে একজন জমিদারের মান-সম্মান, ইজ্জত ও জনগণের ভালবাসা জড়িত ছিল। অবশ্য মেজকুমারের মৃত্যুর খবরটি ৫ আগস্ট ১৯৪৬ জয়দেবপুরে পৌঁছায়।
প্রায় পনেরো একর জায়গাজুড়ে মূল ভবনটি বিস্তৃত। উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৪০০ মিটার দীর্ঘ এ ভবনটির দক্ষিণ পাশে মূল প্রবেশপথ। মূল প্রবেশপথের পরেই রয়েছে প্রশস্ত একটি বারান্দা এবং এর পরে একটি হল ঘর। ভবনের ওপরের তলায় ওঠার জন্য ছিল শাল কাঠের তৈরি প্রশস্ত সিঁড়ি। ভবনের উত্তর প্রান্তে খোলা জায়গায় রয়েছে ‘নাটমণ্ডপ’। একসময় রাজবাড়ির সব অনুষ্ঠান হতো এই মঞ্চে।
অন্যদিকে রাজবাড়ির মধ্যে পশ্চিমাংশের দ্বিতল ভবনের নাম ‘রাজবিলাস’। এ ভবনের নিচে রাজার বিশ্রামাগারের নাম ছিল ‘হাওয়ামহল’। দক্ষিণ দিকে খোলা খিলান যুক্ত উম্মুক্ত কক্ষের নাম ‘পদ্মনাভি’। আর ভবনের দোতলার মধ্যবর্তী একটি কক্ষ ছিল ‘রানীমহল’ নামে পরিচিতি। প্রাঙ্গণের তিন দিক পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে ছিল আবাসনের জন্য নির্মিত বারান্দাযুক্ত কক্ষ। বারান্দা ছিল কক্ষসমূহের দিকে উন্মুক্ত এবং বারান্দাগুলোতে করিন্থিয়াস স্তম্ভের ওপর অর্ধবৃত্তাকার খিলান স্থাপন করা হয়েছিল।
এসব খিলানের উপরে ফাঁকা লম্বাটে নকশা, স্তম্ভে ফুল, লতা ও লম্বা টানা নকশা ছিল। সুরম্য এ ভবনটিতে ছোট বড় মিলে প্রায় ৩৬০টি কক্ষ আছে। রাজবাড়ির সীমানা প্রাচীর মুগ্ধ হবার মতো। রাজবাড়িটির পুরো এলাকাই সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। এই প্রাচীরটিও কারুকার্য খচিত, বেশ উঁচু। প্রধান ফটক থেকে প্রায় অর্ধবৃত্তাকারের দুটো পথের যে কোনো একটা ধরে অগ্রসর হলেই মূল রাজপ্রাসাদ।
বড় দালানের পেছনে (উত্তর পাশে) রয়েছে একটি খোলা প্রাঙ্গণ, এটি নাটমন্দির হিসেবে পরিচিত। এর পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ছিল আবাসনের জন্য নির্মিত বারান্দাযুক্ত কক্ষ। নাট মন্দিরের উত্তর পাশের প্রাসাদগুলো পুরানবাড়ি নামে পরিচিত। ভাওয়াল রাজবাড়ির দরজা-জানালা এবং অধিকাংশ সিঁঁড়ি এবং বারান্দার বেষ্টনীগুলো শাল কাঠের তৈরি।
বড়দালান সংলগ্ন (পূর্ব পাশে) রাজা কালী নারায়ণ রায়ের নিঃসন্তান ভগ্নি কৃপাময়ী দেবীর বাড়ি (ট্রেজারি)। এ ছাড়া রাজবাড়ির পূর্বপাশে ম্যানেজারের অফিস (বর্তমানে জয়দেবপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়), পশ্চিমপাশে দেওয়ানখানা (রানী বিলাস মণি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়), রাজদীঘির পশ্চিমপাড়ে খাসমহল ছিল (ডা. আশু বাবুর বাড়ি)।
১৮৮৭ সালে ও ১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে রাজবাড়িটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের পর রাজবিলাসসহ অন্যান্য ইমারত পুনর্নিমিত হয়। রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় এটি সংস্কার করেন। বর্তমানে এটি জেলাপরিষদ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

তথ্যসূত্র :জেলা তথ্য বাতায়ন।

লেখক - 
অসীম বিশ্বাস 
২য় ব্যাচ, আইন ও ভূমি প্রশাসন


Comments