১৯২৮ সালের ১৪জুন এর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে জন্মগ্রহণ করেন।আইরিস পিতা আর্নেস্তো গেভারা লিনচ ও স্প্যানিশ মাতা সিলিয়া দে সেরনার পাঁচ সন্তানের মধ্যে চে’ই ছিলেন সবার বড়।‘চে’ তার প্রকৃত নাম নয়, যদিও এটিই সবচেয়ে বেশি পরিচিত তার ক্ষেত্রে। স্প্যানিশ ভাষায় ‘চে’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘প্রিয়’; কিউবায় সফল বিপ্লবের পর সেখানকার অধিবাসীগণ তার নাম দিয়ে দেয়-‘চে’।শৈশব থেকেই সমাজের বঞ্চিত,অসহায়,দরিদ্রদের প্রতি এক ধরনের মমত্ববোধ তার ভিতর তৈরি হয়। কারণ তিনি বেড়ে ওঠেন একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার পরিবারে।খুব অল্প বয়সেই তিনি রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান লাভ করেন।
জেদ তার ছোট বেলার সাথী বলা যায়। সারা জীবন হাঁপানিতে ভোগা সত্ত্বেও মল্যবিদ্যা, সাঁতার, ফুটবল,গলফ,শুটিং, রাগবি,দাবা, সাইক্লিংয়ের একজন অক্লান্ত খেলোয়াড় ছিলেন।
বয়সন্ধি থেকেই তার কবিতা আসক্তি শুরু। গুয়েভারা পরিবারে ছিল ৩০০০ এরও বেশি বই যা গুয়েভারাকে করে তোলে একজন জ্ঞান পিপাসু ও আক্লান্ত পাঠক। যার মধ্যে কার্ল মার্ক্স ও লেলিনের বই তাকে ব্যাপক প্রভাবিত করে।
মোটর সাইকেল অভিযান:
১৯৫১ সাল,তরুণ চে যখন সবেমাত্র ডাক্তারির পড়াশোনা করছেন সে সময় সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের ঝোঁক চাপে তার এবং বেড়িয়েও পরেন। ঐ ভ্রমণটি তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ ছিল, কারণ তখনই তার চোখে ভালো করে ধরা পড়ে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সার্বিক অসহায়ত্ব।মোটর সাইকেলে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেরুর সান পেবলোর লেপার কলোনিতে (কুষ্ঠ রোগীদের জন্য বিশেষ কলোনি) স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করা। মাচু পিচ্চুর যাওয়ার পথে তিনি প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের চরম অভাব অনটন দেখে হতাশ হন।এই অভিজ্ঞতা থেকে তার ডায়েরীতে (The Motorcycle Diaries) তিনি লিখেছেন, ‘মানব সত্ত্বার ঐক্য ও সংহতির সর্বোচ্চ রুপটি এ সকল একাকী ও বেপরোয়া মানুষদের মাঝে জেগে উঠেছে’।
এই ভ্রমণ তাকে নিয়ে যায় আর্জেন্টিনা, চিলি, পেরু, ইকুয়েডর,
কলম্বিয়া , ভেনিজুয়েলা, পানামা ও মিয়ামির মধ্য দিয়ে বুয়েন্স আয়রেস এর দিকে| ভ্রমণের শেষ দিকে তিনি এই মত পোষণ করেন যে দক্ষিণ আমেরিকা আলাদা আলাদা দেশের সমষ্টি নয় বরং এক অভিন্ন অস্তিত্ব যার প্রয়োজন মহাদেশ ব্যপী স্বাধীনতার জাগরণ ও স্বাধীনতার পরিকল্পনা।পরবর্তীতে তার নানা বিপ্লবী কর্মকান্ডে এই একক, সীমানাবিহীন আমেরিকার চেতনা ফিরে আসে বার বার।
মেক্সিকো শহর ও কাস্ত্রো:
১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে গেভারা মেক্সিকো শহরে পৌঁছান এবং সদর হাসপাতালে চাকুরি করেন। পাশাপাশি ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভির্সিটি অব মেক্সিকোতে চিকিৎসা বিষয়ে প্রভাষক এবং লাতিনা সংবাদ সংস্থার চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করেন।১৯৫৫ সালের জুন মাসে তার বন্ধু নিকো লোপেজ রাউল কাস্ত্রোর সাথে তার পরিচয় করান এবং পরে তার বড় ভাই ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে পরিচিত হন। কাস্ত্রোর সাথে তার প্রথম সাক্ষাতে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় এবং চে বলেন যে কিউবার সমস্যা নিয়ে তিনি চিন্তিত। তারপর তিনি ছাব্বিশে জুলাই
আন্দোলন দলের সদস্য হন। সেই সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন এই আগ্রাসী তৎপরতার আশু সমাপ্তি প্রয়োজন।
কিউবা বিপ্লব:
কাস্ত্রোর প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালান। ১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পৌছানোর সাথে সাথেই বাতিস্তার সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রন্ত হন। তার ৮২ জন সহচর মারা যান, মাত্র ২২জন এ যাত্রায় বেঁচে যায়!গুয়েভারা লিখেছিলেন সেটা ছিল সেই রক্তক্ষয়ী মুখামুখি সংঘর্ষের সময় যখন তিনি তার চিকিৎসা সামগ্রীর সাথে একজন কমরেডের ফেলে যাওয়া এক বাক্স গোলাবারুদ নিয়েছিলেন, যা তাকে পরিশেষে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীতে পরিণত করে।সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতমালায় বিদ্রোহীদের ছোট্ট একটা অংশ পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়। সেখানে তারা ২৬ শে জুলাই আন্দোলনের গেরিলা এবং স্থানীয় লোকজনদের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন।যুদ্ধচলাকালীন চে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর অখণ্ড অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ফিদেল কাস্ত্রোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কূটনীতি এবং অধ্যবসায়ের কথা জানিয়ে ছিলেন। গুয়েভারা গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি সেকানোর জন্য চুল্লি প্রস্তুত এবং নিরক্ষর সঙ্গীদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালা তৈরি করেন। তাছাড়াও তিনি একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, প্রশিক্ষনের কর্মশালা আয়োজন এবং তথ্য সরবরাহের জন্য পত্রিকা প্রচার করতেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাকে ’’কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’’’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। তার পর তিনি বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান। গেভারা শৃঙ্খলার ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, কর্তব্যে অবহেলাকারীদের তিনি নির্দ্বিধায় গুলি করতেন। তার এই প্রচন্ড মানসিকতা তাকে তার ইউনিটে সবার চেয়ে ভয়ংকর করে তুলেছিল। তাই গেরিলা অভিযানের সময় গুপ্তঘাতকদের মৃত্যুদন্ড দেবার দায়িত্ব ছিল তার উপর। চে এমন কঠিন প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও সৈন্যদের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং কাজের ফাঁকে তাদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও করতেন।
কিউবায় মন্ত্রীত্ব ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি:
১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চে কিউবার শিল্প বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এসময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে আলজিয়ার্স সফরকালে সোভিয়েত সরকারকে সাম্রাজ্যবাদের দোঁসর আখ্যা দেয়ার ফলে দেশে ফেরার সাথে সাথে তার মন্ত্রীত্ব বাতিল হয়।
১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে গুয়েভারা বিশ্বের বিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি পান। তাই তিনি কিউবার প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান করার জন্য নিউইয়র্ক শহরে যান। ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের ১৯তম অধিবেশনে আবেগ অভিভূত বক্তৃতায় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত বৈষম্যের কঠোরনীতি দমনে জাতিসংঘের দুর্বলতার কথা বলেন।এটাকে বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘের কোন পদক্ষেপ আছে কি না জানতে চেয়ে প্রশ্ন তোলেন। গুয়েভারা তখন নিগ্রো জনগনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কঠোর নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ক্রোধান্বিত গুয়েভারা ‘সেকেন্ড ডিক্লেরেশন অব হাভানা’ নামক একটি আবেগপূর্ণ ঘোষণার উল্লেখ করে তার বক্তৃতা শেষ করেন। তিনি বলেন যে তার এই ঘোষণার জন্ম হয়েছে ক্ষুধার্ত জনগণ, ভূমিহীন কৃষক, বঞ্চিত শ্রমিক ও প্রগতিশীল মানুষের দ্বারা। বক্তব্যের শেষ করতে গিয়ে তিনি আরো বলেন, সারা বিশ্বের শোষিত জনগোষ্ঠীর একমাত্র চিৎকার এখন -
হয় স্বদেশ অথবা মৃত্যু।
কঙ্গো ও বলিভিয়া:
১৯৬৫ সালে চে আফ্রিকায় যান এবং কঙ্গোতে চলমান যুদ্ধে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান কাজে লাগাবার প্রস্তাব দেন।আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপতি আহমেদ বিন বেল্লা ও মিশরের রাষ্ট্রপতি জামাল আব্দেল নাসেরর সতর্কতা সত্ত্বেও গেভারা মার্কসবাদীদের সহায়তায় আক্রমণ চালিয়ে যাবার জন্য তৈরি হন। ১৯৬৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি, তার সেকেন্ড কমান্ড ভিক্টর বার্ক এবং ১২ জন সহচরী নিয়ে কঙ্গোয় পৌছান। তার কিছু দিনের মধ্যে প্রায় ১০০ জন আফ্রো-কিউবান তাদের সাথে যোগ দেন।এখানে তিনি কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়া লুমুম্বা ব্যাটেলিয়ন সংগঠনের দায়িত্ব নেন। গুয়েভারা অবস্থান সম্পর্কে তখন লোকজন জানত না।১৯৬৬ সালের শেষের দিকে অথবা ১৯৬৭ এর শুরুর দিকে জমবিক স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিনিধির সাথে ডার এস্ সালাম নামক স্থানে দেখা হয়। সেখানে গুয়েভারা তাদের বিপ্লবী কর্মকান্ডে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে হাভানায় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে পদযাত্রায় এক মন্ত্রী বলেন যে চে লাতিন আমেরিকার কোন জায়গায় বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন। তারপর প্রমাণিত হয় যে তিনি বলিভিয়ায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। কাস্ত্রোর আদেশে তিনি মন্টেন ড্রাই ফরেষ্ট নামক দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষণ চালান যেখানে বলিভিয়ার স্থানীয় সমাজতান্ত্রিকরা তাকে সাহায্য করেছিল।
গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ড:
১৯৬৭ সালের ৯ই অক্টোবর বলিভিয়ার লা হিগুয়েরা গ্রামের একটি স্কুলঘরে আটকে রেখে বেলা ১.১০য়ে তাকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকারী ছিলেন বলিভিয়া সেনাবাহিনীর মদ্যপ সার্জেন্ট মারিও তেরান। চে-কে ধরা ও হত্যা করার পেছনে কাজ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। মৃত্যুর পরপরই তিনি বিশ্বজুড়ে বিপ্লবীদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন। তাকে হত্যার পেছনে লাতিন আমেরিকার একনায়ক শাসক আলফ্রেদো ট্রয়েসনারের হাত ছিল বলে তথ্য দিয়েছেন প্যারাগুয়ের গবেষক মার্টিন আলমাদা। কারণ ‘চে‘ তার বিরুদ্ধেও গেরিলা যুদ্ধ শুরু করতে পারেন বলে তার ভয় ছিল।তবে আরেকটি মতামত হচ্ছে এই দিন যুদ্ধে বন্দী হলেও তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় কিছুদিন পর। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে পরবর্তীতে এইসব দাবির স্বপক্ষে কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়।১৯৯৭ সালে ভ্যালেগ্রান্দের একটি গণকবরে 'চে' ও তার সহযোদ্ধাদের দেহাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।পরবতী চে’কে সমাহিত করা হয় কিউবার সান্তা ক্লারায়, তার ভালবাসার স্থানে।টাইম পত্রিকায় বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির যে তালিকা করেছে সেখানে তার নামও রয়েছে।এভাবেই মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যু হয় বিপ্লবী কমরেড 'চে' য়ের কিন্তু বিপ্লব শেষ হয়ে য়ায় না চে’ও তাই বেঁচে থাকবেন হাজারো বিপ্লবীদের হৃদয়ে।
প্রদত্ত ছবিটির নাম গেরিলেরো হেরোইকো (বীর গেরিলা) আলবের্তো কোর্দা কর্তৃক তোলা, যা পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয় আলোকচিত্র।
তথ্যকোষ :
১.উইকিপিডিয়া
২.রোর বাংলা
৩.বলিভিয়ান ডায়েরী
৪.মোটরসাইকেল ডায়েরী
৫. বিবিসি নিউজ
৬.দৈনিক ইত্তেফাক
৭.প্রথম আলো
লেখক :
অনিক সরকার
২য় ব্যাচ, আইন ও ভূমি প্রশাসন
Informative and self contained.
ReplyDeleteThank you
Deleteখুবই চমৎকার এবং তথ্যবহুল লেখা। এগিয়া যাও অনুজ।
ReplyDelete