এক যুদ্ধ অপর যুদ্ধকে ছাড়িয়ে যায় ভয়াল রুপ দিয়ে। সেই ভয়াল রূপ কাঁপিয়ে দেয় পুরো মানবজাতিকে, যা চলে আসছে মানব সভ্যতার সৃষ্টিলগ্ন থেকে। যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই সমূহ ক্ষয়ক্ষতি হয় কিন্তু এমন যুদ্ধ কি সম্ভব যেখানে সরাসরি যুদ্ধ না হয়ে যুদ্ধ হবে ভিন্ন চিন্তাধারায়, নীতিতে, উদ্ভাবন প্রতিযোগিতায় এমনকি সংস্কৃতিতে। হ্যাঁ ,এমন যুদ্ধই হয়েছিল পৃথিবীর দুই পরাশক্তির মধ্যে। যেটি স্নায়ু যুদ্ধ বা কোল্ড ওয়ার নামে পরিচিত। স্নায়ু যুদ্ধ পৃথিবীকে চিরতরে বদলে দেয়। কিন্তু কেমন ছিল এই যুদ্ধ? কিভাবেই বা হয় এর সূচনা? আর কি ই বা ছিল এর পরিনতি?
স্নায়ুযুদ্ধ মূলত শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এবং এর স্থায়ীত্ব ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত। কিন্তু এই যুদ্ধের পটভূমি তৈরি হয় অনেক পূর্বেই। রাশিয়ান বিপ্লবের পর থেকেই পশ্চিমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাড়ায় রাশিয়া। কারণ রাশিয়ার সামরিক শক্তি বা সামরিক স্বৈরশাসন না। এর কারণ ছিল রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও শাসন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থাকে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের ব্যবস্থার জন্য ঝুঁকি মনে করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে এই ধারণা পশ্চিমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সঙ্গে পুরো পৃথিবীর উপর কতৃত্তের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়।
পশ্চিমা শক্তির সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে চিন্তার আরেকটি কারণ হল স্টালিন প্রথমে অক্ষ শক্তির সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এবং পরর্তীতে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করলে সোভিয়েতরা মিত্র শক্তিতে যোগ দেয়। বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যুদ্ধ পরবর্তী সিদ্ধান্তের কারণে ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তিগুলো এলটার কনফারেন্সে যোগ দেয়। এখানে পুরো জার্মানিকে চার ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু মিত্র শক্তিগুলোর ভিন্ন ভিন্ন উদ্যেশ্য ছিল। রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই লক্ষ্য ছিল এশিয়াতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। এ নিয়েই মূলত রেশারেশি শুরু হয়। রাশিয়া একদিকে এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত অন্যদিকে জাপান এবং এশিয়ার রাজনীতি ও ব্যবসায় প্রভাব বিস্তারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পৃথিবীতে দুই মিত্র শক্তি প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় স্নায়ুযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু কি হয়েছিল স্নায়ুযুদ্ধে?
স্নায়ু যুদ্ধ পুরোটাই ছিল এক অস্থিরতার সময়। পৃথিবীর মানুষ এর আগে এত শঙ্কিত সময় পার করেনি। স্নায়ু যুদ্ধে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও জড়িয়েছিল অনেক গুলো প্রক্সি ওয়ারে। অর্থ্যাৎ তখনকার যুদ্ধগুলোতে অস্ত্র দিয়ে এবং অর্থায়ন করে সাহায্য করেছিল। এমনই এক শুরুর দিকের যুদ্ধ ছিল কোরিয়ান যুদ্ধ। যার সমাধান আজো হয়নি। ভিয়েতনাম যুদ্ধও স্নায়ুযুদ্ধেরই অংশ ছিল। এমনকি আমাদের স্বধীনতা যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া এই প্রক্সি ওয়ারে জড়িত ছিল। এছাড়াও তৈরি হয়েছিল অরেকটি বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি। এমনই এক পরিস্থিতি ছিল কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার নিকটবর্তী তুরস্কে পারমানবিক মিসাইল সিস্টেম তৈরি করলে রাশিয়াও কিউবায় তাদের পারমাণবিক মিসাইল পাঠানোর চেষ্টা করে এবং তৈরি হয় পারমাণবিক যুদ্ধের পরিস্থিতি।
এই পরিস্থিতি থেকে পৃথিবীবাসী রক্ষা পেলেও থেমে যায়নি ভয়ঙ্কর সব পারমানবিক অস্ত্রের পরীক্ষা। রাশিয়া তৈরি করেন হাইড্রোজেন বোম্ব যা হিরোশিমা নাগাসাকির চেয়ে হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্রও থেমে থাকেনি তারাও একের পর এক নতুন পারমানবিক বোম্ব এর পরীক্ষা চালায়৷ সে সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতাও অনেক বেড়ে গিয়েছিল। রাশিয়ান কেজিবি ও মার্কিন সি আই এ দুই সংস্থাই নিয়ুক্ত ছিল অনেক গুপ্ত অভিজানে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দুই সামরিক জোট। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো এবং রাশিয়ার ওয়ারসো প্যাক্ট। মূলত স্নায়ু যুদ্ধের সময় পুরো পৃথিবী মত্ত ছিল এক বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক খেলায়। কিন্তু কী ছিল এর পরিনতি? কীভাবেই বা হয় এর সমাপ্তি?
স্নায়ু যুদ্ধ সামরিক, প্রযুক্তি থেকে চিকিৎসা সকল ক্ষেত্রেই উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করে। এই যুদ্ধেরই একটি ফলাফল ছিল মানুষের মহাকাশ জয়। সোভিয়েত ইউনয়ন মহাকাশে প্রথম মানুষ প্রেরণ করলে এরই রেষ ধরে যুক্তরাষ্ট্র চন্দ্র জয় করে। তাছাড়াও এই সময়ে পারমানবিক যুদ্ধের ভয়ে মহাকাশে অনেক স্যাটালাইট প্রেরণ করা হয়। উন্নয়ন হয় বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে। দুই পরাশক্তির প্রতিযোগিতায় তৈরি করা হয় নতুন সব প্রযুক্তি। ইন্টারনেট, সুপার কম্পিউটর, জেট বিমান। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও আবিষ্কৃত হয় নতুন সব প্রতিষেধক ও চিকিৎসা পদ্ধতি। ব্যবসা বাণিজ্যেও আসে বিশ্ববাজারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ধারা। পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টে যায় দ্রুত। জন্ম হয় নতুন অনেক দেশের। মোটকথা, স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন এই দীর্ঘ ৪৫ বছর পুরো পৃথিবী একটি সঙ্কিত সময় পার করলেও এই যুদ্ধ পুরো পৃথিবীকে ঢেলে সাজিয়েছিল।কিন্তু ১৯৯১ সালে মার্কিন কূটনীতির কাছে সোভিয়েত ইউনিয়ন এর পতন হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫ টি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র। এর সঙ্গেই সমাপ্তি ঘটে স্নায়ু যুদ্ধের। অবশ্য ১৯৮৯ সালের বিপ্লব এবং ইউএসএসআর বিলোপের উভয়ই কোল্ড ওয়ারের শেষ ইঙ্গিত দেয়। এভাবেই স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গেই থেমে যায় পরশক্তিগুলোর আগ্রাসী সামরিক মনোভাব এবং পৃথিবির অস্থিরতম সময়ের।
তথ্যসূত্র -
১.বিবিসি
২.উইকিপিডিয়া
লেখক -
সিফাত হোসেন
Comments
Post a Comment