জেলার নাম : যশোর
জেলার পটভূমি :
বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডটি প্রাচীনকালে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ইতিহাসে এসব রাজ্য ভাংগা, পান্ডু, সমতট, তাম্রলিপ্ত, বঙ্গ ইত্যাদি নামে পরিচিত। উক্ত সময়ে যশোর সম্ভবত তাম্রলিপ্ত ও ভাংগা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীকালে যশোর সহ সন্নিহিত অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগলিক ও বৈপ্লবিক ইতিহাস বহু উত্থান-পতন আর বিচিত্রতায় পূর্ণ।
গংগা নদীর পলল অবক্ষেপণে সৃষ্ট যশোর জেলার সবচেয়ে পুরাতন বিবরণ পাওয়া যায় টলেমির মানচিত্রে। মহাভারত, পুরান, বেদ ও আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে এ অঞ্চলের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ জেলার অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এক সময় এই অঞ্চল গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। অনার্য জাতিবলে পরিচিত এক শ্রেণীর আদিম মানুষ জংগল পরিস্কার করে সর্ব প্রথম এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
নামকরণের ইতিহাস :
যশোর জেলার নামকরণ অনুসন্ধানে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যশোর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। ঐতিহাসিকগণের মধ্যেও এ জেলার নামকরণ সম্পর্কে মতবিরোধ দেখা যায়। সেহেতু এ বিষয়ে কোন একক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। প্রতিষ্ঠাকালের দিক থেকে যশোর বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরাতন জেলা।
যশোর একটি অতি প্রাচীন জনপদ। আনুমানিক ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পীর খান জাহান আলীসহ বারজন আউলিয়া যশোরের মুড়লীতে ইসলাম ধর্ম প্রচারের প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করেন। ক্রমে এ স্থানে মুড়লী কসবা নামে একটি নতুন শহর গড়ে উঠে । ১৫৫৫ খ্রীস্টাব্দের দিকে যশোর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যশোর-খুলনা-বনগাঁ এবং কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের অংশ বিশেষ যশোর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৭৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে যশোর নাটোরের রাণী ভবানীর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে যশোর একটি পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং এটিই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম জেলা। ১৮৬৪ সালে ঘোষিত হয় যশোর পৌরসভা। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে যশোর জিলা স্কুল, ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে যশোর পাবলিক লাইব্রেরি, বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় ও চতুর্থ দশকে যশোর বিমান বন্দর এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কলকাতার সাথে যশোরের রেল-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম স্বাধীন হওয়া জেলাটি যশোর।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম উল্লেখযোগ্য এ জেলাটির সৃষ্টি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দুইশত বৎসর পূর্বে ১৭৮৬ সালে। পাক-ভারত উপ-মহাদেশে বৃটিশের আগ্রসী রাজত্ব শুরু হওয়ার ফলে যশোরসহ সমগ্র বঙ্গ ইংরেজ শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয়। চিরকালের আপোসহীন সংগ্রামী যশোরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপারগ হলে ইংরেজ শাসকগণ তাদের শাসন কাজের সুবিধার জন্য যশোরকে একটি ভূখন্ডে নির্দিষ্ট করে তাকে স্বতন্ত্র জেলায় রূপান্তরিত করে। প্রথম প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন যশোর জেলার সীমানা-খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং আজকের চুরাশিপূর্ব অবিভক্ত যশোরসহ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিশাল অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল।
যশোর জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুইশত বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় চারশ বছর পূর্বে ১৬৭৪ থেকে পরবর্তীকালের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যশোর একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল এবং স্বাধীন নৃপতিগণ কর্তৃক শাসিত হত। এক সময়ের ভাটির দেশ বলে পরিচিত তৎকালীন স্বাধীন যশোর রাজ্যের সীমানা-পূর্বে মধুমতি নদী, উত্তরে হরিণঘাটা, পশ্চিমে ভারতের কুশদ্বীপ ও প্রাচীন ভাগীরথী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর বিস্তৃত ছিল।
স্বাধীন যশোর রাজ্যের যারা শাসক ছিলেন তাঁদের মধ্যে মহারাজ বিক্রমমাদিত্য, রাজা প্রতাপাদিত্য, রাজা সীতারাম রায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেউ কেউ মনে করেন বিখ্যাত সাধক ও ইসলাম প্রচারক খাঁন জাহান আলী যশোরের স্বাধীন শাসনকর্তা ছিলেন। আবার কেউ বলেন খাজা খাঁন জাহান আলী ছিলেন দিল্লীর সুলতান মামুদ শাহ কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দিল্লীর সম্রাটগণ কর্তৃক প্রেরিত প্রতিনিধি কিংবা স্থানীয় শাসকগণ যশোরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন, কিন্তু বার বার সে বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করা হয়েছে। ১৮৬০ সালের কৃষক ও নীল বিদ্রোহের সময় ইংরেজ শাসকদের পক্ষে বিশাল যশোরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা পুনরায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তখন ইংরেজগণ খুলনা, ঝিনেদা, মাগুরা এবং নড়াইলকে উপ-বিভাগ (মহাকুমা) রূপান্তরিত করে (১৮৬১-৬২)। ১৮৬৩ সালে জেলার দক্ষিণাংশ সাতক্ষীরাকে চব্বিশ পরগণা জেলার সংগে যুক্ত করা হয়। এর দীর্ঘ বিশ বছর পর ১৮৮১ সালে পুনরায় যশোরকে ভেংগে এ জেলার মহকুমা খুলনাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। এই একই সময়ে আবার সাতক্ষীরাকে চবিবশ পরগণা থেকে আলাদা করে নব গঠিত খুলনা জেলার সংগে যুক্ত করে মহকুমায় উন্নীত করা হয়। ১৮৬৩ সালের শেষভাগে পশ্চিম বাংলার বনগ্রাম মহকুমাকে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে যশোরসহ সমগ্র বঙ্গ একটি স্বাধীন এবং শক্তিশালী রাজ্য ছিল। খ্রীস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর টলেমীর মানচিত্রে তার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালের পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্তও যশোর বঙ্গের অধীন ছিল বলে অনুমান করা হয়। খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে উত্তর ভারতের গুপ্ত সম্রাজ্যের সমুদ্র গুপ্ত তার সম্রাজ্য বঙ্গদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করলে যশোরসহ সন্নিহিত অঞ্চল তার সম্রাজ্যভুক্ত হয় ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে গুপ্ত সম্রাজ্যের পতন ঘটলে যশোর পুনরায় ভাংগা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।
সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়ের সম্রাট শশাংক কর্তৃক বঙ্গদেশ অধিকৃত হলে যশোর তার সম্রাজ্যভুক্ত হয়। শশাংকের কাছ থেকে সম্রাট হর্ষবর্ধন এ অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেন।
সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে সংক্ষিপ্তকালের জন্য যশোর বৌদ্ধ রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাবের পর নিজ নিজ কর্মফলের উপর মানুষের ভবিষ্যত নির্ভরশীল বৌদ্ধধর্মের এ মূলনীতি এ ধ্বংসস্তুপ তাদের স্মৃতি বহন করে।
রাজা যশোরমণি নামে একজন রাজা বৌদ্ধদের কাছ থেকে এ অঞ্চলের শাসন ভার অধিকার করেন। যশোরমণির পরে পাল রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। পাল রাজাগণ ১০৮০ সাল পর্যন্ত যশোরসহ সন্নিহিত অঞ্চল তাদের শাসনক্ষেত্রে অন্তর্ভূক্ত রাখেন। পাল রাজত্বের পর বর্মন রাজাগণ ১১৫০ সালে পর্যন্ত যশোর শাসন করে বলে জানা যায়। এরপর এখানে সেন রাজাগণ তাদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। সেন রাজাগণ ১২০৪ সাল পর্যন্ত যশোর তাঁদের শাসনকাল অব্যাহত রাখে । লক্ষণসেন এই বংশের শেষ রাজা।
১২০৪ সালে ইখতিয়ারুদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নামে দিল্লীর সম্রাট শিহাবুদ্দীনের একজন মুসলিম সেনাপতি বংগদেশে সেন রাজ বংশের পতন ঘটিয়ে বংগদেশ অধিকার করেন এবং এই উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম শাসনের অন্তর্ভুক্ত হয় সে বিষয়ে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়।
চতুর্দশ শতাব্দীর দীর্ঘ সময় পর্যন্ত যশোর ছিল দিল্লীর সম্রাটগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। উক্ত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ নামক একজন স্বাধীন নৃপতি বংগদেশ জয় করলে যশোর তাঁর শাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর থেকে এ অঞ্চল পর্যায়ক্রমে স্বাধীন নৃপতিদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে।
১৪৮৭ সালে ইলিয়াস শাহী বংশের পতন ঘটিয়ে দাস বংশ তাদের রাজত্ব শুরু করে। দাসরাজগণ ১৪৯৩ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এখানে তাঁদের অধিকার টিকিয়ে রাখেন। দাস বংশের পতনের পর যশোর সুলতান আলাউদ্দীন হুসেন শাহের শাসনাধীন চলে যায়। ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত হুসেনশাহী বংশ এ অঞ্চলের তাঁর শাসনকাল অব্যাহত রাখেন।
পরবর্তীকালের ইতিহাসের অন্যতম প্রসিদ্ধ পাঠান সম্রাট শেরশাহ বঙ্গদেশাধিকার করলে যশোর তাঁর সম্রাজ্যভুক্ত হয়। পাঠান রাজত্বের পর বিখ্যাত মোগল রাজবংশ পাক-ভারত উপমহাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে তাদের স্মরণীয় শাসনকালের সূচনা করে। এ সময় বিখ্যাত মোগল সম্রাট আকবর প্রথম এই অঞ্চলে ফৌজদার নিযুক্ত করে শাসনের ব্যবস্থা করেন। যশোরের প্রথম ফৌজদার ছিলেন ইনায়েত খাঁ। এরপর সরফরাজ খাঁ, নুরুল্লা খাঁ পর্যায়ক্রমে যশোরের ফৌজদার নিযুক্ত হয়ে আসেন।
নবাবী শাসনামলে বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খাঁর শাসনকালে সীতারাম রায় নামক একজন স্থানীয় রাজা কর্তৃক যশোর শাসিত হত। সীতারাম ছিলেন উত্তর রাঢ় বংশীয় কায়স্থ। তার পিতা উদয় নারায়ণ ভূষণার ফৌজদারের অধিনে একজন তহশীলদার ছিলেন। রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী ছিল মহম্মদপুর।
রাজা সীতারাম রায় মুর্শিদকুলী খাঁকে অমান্য করলে নবাব তার বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে সীতারাম রায় পরাজিত হন। সীতারামের পতনের পর যশোর কয়েকটি জমিদারীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নাটোরের জমিদার জেলার পূর্বাংশ, চাঁচড়ার জমিদার জেলার দক্ষিণাংশ এবং নলডাংগার জমিদার উত্তরাংশ তাদের জমিদারীর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে গৌড়ের শাসনকর্তা দাউদের একজন বিশ্বস্ত সহযোগী শ্রীহরি ১৫৭৪ সালের যশোরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীন যশোর রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ইতিহাসে এই শ্রীহরিই মহারাজ বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত। বিক্রমাদিত্য গৌড়ের রাজা দাউদ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ঈশ্বরপুর এবং তেকাটিয়া ছিল বলে জানা যায়। ১৫৮৬ খ্রীষ্টাব্দে বিক্রমাদিত্য মৃত্যুবরণ করেন। বিক্রমাদিত্যের শাসনকালে তার বিশ্বস্ত সহযোগী ও জ্ঞাতিভ্রাতা বসন্ত রায়ই যশোরের প্রকৃত শাসক ছিলেন। গৌড় থেকে লুট-করা অঢেল ধন-সম্পদ দ্বারা যশোরকে বসন্ত রায়ই ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গড়ে তোলেন।
বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৫৮৭ সালে তদীয় পুত্র প্রতাপাদিত্যকে বসন্ত রায় যশোরের রাজা বলে ঘোষণা করেন। প্রতাপাদিত্যের প্রকৃত নাম গোপীনাথ। ১৫৬০ সালে তিনি গৌড়ে জন্মগ্রহণ করেন। প্রতাপাদিত্য তার প্রাপ্ত উপাধি। সুন্দরবন অঞ্চলের ধুমঘাট ছিল প্রতাপের রাজধানী। ১৪০০ সালের দিল্লীর সম্রাট নাসির শাহ অথবা মাবুদ শাহ খাজা জাহান বা খাঁন জাহান আলী নামক একজন উচ্চপদস্থ সহযোগীকে জায়গীর প্রদান করে বঙ্গদেশে প্রেরণ করেন। খাজা জাহান বা খাঁন জাহান আলী সম্রাট মামুদ শাহ কর্তৃক প্রদত্ত উপাধি। তাঁর প্রকৃত নাম উলুঘ খাঁন। বংগদেশে এসে খাঁন জাহান আলী যশোর অঞ্চলের শাসনভার প্রাপ্ত হন এবং দেশ শাসন এবং ইসলাম প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। পরবর্তীকালে তিনি একজন বিখ্যাত ইসলামী সাধক ও ধর্ম প্রচারক হিসাবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক এই খাঁন জাহান আলীকে জৌনপুর রাজ্যের অধিবাসী ও প্রতিষ্ঠাতা এবং সেখান থেকে তিনি এদেশে আগমন করেন বলে অনুমান করেন। যশোর শহরে সমাধিস্থ হযরত গরীব শাহ ছিলেন খাঁন জাহানের অন্যতম প্রধান সহযোগী। যশোরের পয়গ্রাম কসবা খাঁন জাহান আলীর রাজধানী ছিল। প্রাচীন যশোরের বাগেরহাটে খাঁন জাহান আলীর সমাধি এবং তাঁর বহু কীর্তি চিহ্ন আজও তাঁর স্মৃতি বহন করছে।
১৭৫৭ সালে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উ-দৌলার পতন ঘটলে এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে অস্থায়ীভাবে বন্দী হয়। শুরু হয় ইংরেজ রাজত্ব-চলে বর্ণ বৈষম্যবাদী শাসন। প্রায় দুইশত বছর ইংরেজগণ উপমহাদেশে তাদের শোষণ ও নির্যাতনের শাসনকাল অব্যাহত রাখে।
১৮৫৭ সাথে ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ থেকে শুরু করে পরবর্তী কালের নীল বিদ্রোহ, কৃষক সংগ্রাম ও স্বদেশ আন্দোলনসহ অসংখ্য বিপ্লব একের পর এক ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। অতঃপর ১৯৪৭ সালে ইংরেজগণ এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়।
১৯৪৭ সনের সেই দেশ বিভাগের সময় যশোরকে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীরা দীর্ঘ দুই যুগ এ অঞ্চলকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করে এবং অগ্রাসী রাজত্বের নজীর বিহীন শোষণ ও অপশাসন চালিয়ে যায়।
১৯৪৭ সালে ইংরেজগণ উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়। যাবার আগে তারা এদেশে তাদের অপকৌশলের বীজ প্রোথিত করে যায়। এতে সৃষ্ট হয় দেশ বিভাগের। ফলে অভিভক্ত বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে জন্ম দেওয়া হয় দুটি দেশ-ভারত ও পাকিস্তান। এর মধ্যে পাকিস্তান নামক তথাকথিত দেশটির গঠন ছিল একান্তই অসচেতন ও অবাস্তব চিন্তা চেতনার ফসল যা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে।
সাতচল্লিশের সেই দেশ বিভক্তির ফলে অভিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলকে করা হল অস্থায়ী পাকিস্তানের অংশ এবং পশ্চিমাঞ্চলকে ভারতে। এর মধ্যে সীমানারেখা নির্ধারণের ফলে আবার পরিবর্তন হল জেলা যশোরের ভৌগলিক অবস্থানের। এতে যশোরের বনগ্রাম মহকুমাকে পুনরায় ভারতের সংগে যুক্ত করা হয়।
১৮৭৬ থেকে ১৯৮৪ অব্যাহতভাবে চলতে থাকে যশোরের গঠন ও পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়া। ১৯৬০ সালে জেলার মাগুরা মহকুমার মহম্মদপুর থানার অংশ এবং নড়াইলের আলফাডাংগা থানাকে ফরিদপুর জেলার সংগে যুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক উন্নয়নকল্পে আজকের যশোরকে ভেংগে পুনর্গঠন করেছে। ফলে জেলার চার মহকুমা নড়াইল, মাগুরা,ঝিনেদা এবং সদর স্বতন্ত্র চারটি জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ আবার এ জেলার সীমানা ও প্রশাসনিক বিভক্তি ঘটেছে। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে পরিবর্তিত হতে হতে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও সুপ্রাচীন যশোর জেলা আজ শুধুমাত্র তার একটি খন্ডিত অংশ নিয়ে টিকে আছে। ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যায় যশোরসহ সন্নিহিত অঞ্চল বহু উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন শাসক ও শাসিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত থেকেছে।
১৯৭১ সালে বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও মানবতাবাদী নেতা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংঙ্গালীরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ্য নিরপরাধী মানুষকে পাকিস্তানী হায়েনারা নৃশংসভাবে হত্যা করে ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ ও ভয়াবহ গণহত্যার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যা মাইলাই হত্যাকান্ডের চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল। সেই সংঙ্গে তাদের নারী নির্যাতনের পৈশাচিকতাও অতীতের সকল নারকীয়তাকে হার মানায়।
বাংলাদেশের ইতিহাস ইংরেজ বিতাড়ন, পাকিস্তানী উচ্ছেদ, নীল বিদ্রোহ, তে-ভাগা আন্দোলন, কৃষক সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রণী যশোরের সংগ্রামী মানুষ ন্যায়ের স্বপক্ষে অধিকার আদায়ের বিপ্লবে তাদের বলিষ্ট উচ্চারণ রেখেছে বার বার। স্বভাবতই সংস্কৃতির পীঠস্থান এই যশোরের রয়েছে
গৌরবময় অতীত যা ভবিষ্যত বংশধরদের কাছে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
আবহমানকাল ধরেই যশোরের জনগণ বীর ও স্বাধীনচেতা। দেশ ও জাতির যে-কোন দুর্যোগময় মুহূর্তে যশোরের মানুষ জীবন বিপন্ন করে ঝাপিয়ে পড়েছে চেতনার উদ্বুদ্ধতায়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যশোর বাসীর অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয় যশোর থেকেই।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে আজকের যশোর তারই একটি সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং তার প্রকৃত অস্তিত্ব লাভ করে।
যশোর জেলা : বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের একটি জেলা।
যশোর জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের একটি প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন অঞ্চল।
★যশোরের অন্য একটি প্রচলিত বানান যশোহর।
* ব্রিটিশ আমলে খুলনা ছিল যশোর জেলার অধিভুক্ত একটি মহুকুমা।
বাংলাদেশে যশোর জেলার অবস্থান :
- যশোর বাংলাদেশের ১৩ তম বৃহত্তম জেলা।
- স্থানাঙ্ক: ২৩°১০′১২″ উত্তর ৮৯°১২′০″ পূর্ব
- বিভাগ: খুলনা বিভাগ
- আয়তন: মোট ২৬০৬.৯৪ কিমি২ (১০০৬.৫৫ বর্গমাইল)
- উচ্চতা: ৭ মিটার (২৩ ফুট)
- জনসংখ্যা (২০১১ আদমশুমারি)[১]• মোট ২৭,৬৪,৫৪৭
- জনঘনত্ব ১১০০/কিমি২ (২৭০০/বর্গমাইল)
- সাক্ষরতার হার • মোট ৯৫%
- সময় অঞ্চল বিএসটি (ইউটিসি+৬)
- পোস্ট কোড : ৭৪০০
- প্রশাসনিক বিভাগের কোড: ৪০ ৪১
- উপজেলার নাম: যশোর সদর উপজেলা
- উপজেলা: ৮টি
- পৌরসভার নাম: যশোর সদর পৌরসভা
- পৌরসভা/Municipality : ৮টি
- উল্লেখ্য পৌরসভার প্রধানকে মেয়র বা পৌরপিতা বলে।
- থানা : ৯টি
- সদর থানা : কোতয়ালী (Kotwali)
- ইউনিয়ন : ৯৩টি
- উল্লেখ্য ইউনিয়নের প্রধানকে চেয়ারম্যান বলে।
যশোর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত মেলে। ঐতিহাসিকদের মধ্যে এই জেলার নামকরণ সম্পর্কে মতবিরোধ দেখা যায়। আরবি ‘জসর’ থেকে যশোর শব্দের উৎপত্তি বলে মনে করেন অনেকে। এর অর্থ সাঁকো। এককালে যশোরের সর্বত্র নদীনালায় পরিপূর্ণ ছিল। নদী বা খালের ওপর সাঁকো বানানো হতো। পীর খানজাহান আলী বাঁশের সাকো নির্মাণ করে ভৈরব নদী পেরিয়ে মুড়লীতে আসেন বলে জানা যায়। এই আরবি শব্দ 'জসর' (বাংলায় যার অর্থ বাঁশের সাঁকো) থেকে যশোর নামের উৎপত্তি। অনুমান করা হয় কসবা নামটি পীর খানজাহান আলীরই দেওয়া (১৩৯৮ খৃঃ)। তবে অনেকের অভিমত, খানজাহান আলী আসার আগে থেকেই ‘যশোর’ নামটি ছিল।
আবার অন্য একটি সূত্র হতে জানা যায় যে- মহারাজ প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্য ও তার এক সহযোগি বসন্ত রায় গৌড়ের এক চরম অরাজকতার সময় সুলতানের অপরিমিত ধনরত্ন নৌকা বোঝাই করে গোপনে এই এলাকায় প্রেরণ করেন। গৌড়ের ধনরত্ন বোঝাই অসংখ্য নৌকা এখানে পৌঁছানোর পর ধীরে ধীরে বন জঙ্গলে আবৃত্ত এলাকাটির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। প্রতিষ্ঠিত হলো একটি সমৃদ্ধ রাজ্য। নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নামকরণ হল যশোহর। প্রবাদ আছে, গৌড়ের যশ হরণ করে এই এলাকার শ্রীবৃদ্ধি হওয়ায় নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নাম যশোহর রাখা হয়। স্থানীয় পুরাতন নাম যশোর পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন নামকরণ হয় যশোহর। 'যশোর' শব্দটি 'যশোহর' শব্দের অপভ্রংশ।
ভৌগোলিক সীমানা :
উত্তরে ঝিনাইদহ জেলা ও মাগুরা জেলা, দক্ষিণ পূর্বে সাতক্ষীরা জেলা, দক্ষিণে খুলনা জেলা, পশ্চিমে ভারত। পূর্বে নড়াইল জেলা।
প্রশাসনিক এলাকা :
এ জেলায় ৮টি উপজেলা রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি পুলিশ থানা রয়েছে এবং একটি পোর্ট থানা রয়েছে।
১.যশোর সদর উপজেলা
২.অভয়নগর উপজেলা
৩.কেশবপুর উপজেলা
৪. চৌগাছা উপজেলা
৫. ঝিকরগাছা উপজেলা
৬.বাঘারপাড়া উপজেলা
৭. মনিরামপুর উপজেলা
৮. শার্শা উপজেলা
•বেনাপোল পোর্ট থানা
বিখ্যাত ব্যক্তি :
১। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত
২। কর্মবীর মুন্সী মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহ
৩।রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার (১৮৫৯-১৯৩২)
৪। জ্যোতিস্ক বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ (১৮৭৮-১৯৭৫)
৫। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শিশির কুমার ঘোষ
৬। এ্যাডভোকেট শহীদ মশিউর রহমান
৭। যতীন্দ্রনাথ মূখোপাধ্যয় (বাঘা যতীন, ১৮৭৯-১৯১৫)
১০। বেগম আয়েশা সরদার (নারী আন্দোলনের নেত্রী, ১৯২৭-১৯৮৮)
১১। শিক্ষাবিদ আব্দুর রউফ (১৯০২-১৯৭১)
১৩। বিশিষ্ট সমাজসেবক ও রাজনীতিবিদ এ্যাডভোকেট রওশন আলী
১৪। কে পি বসু (কালিপদ বসু, ১৮৬৫-১৯১৪)
১৫। আলোকচিত্রকর মোঃ সফি
১৬। মোশাররফ হোসেন
১৭। এস এম.সুলতান
প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের উল্লেখযোগ্য কার্যাবলী /অর্জন :
যশোর জেলার কেশবপুর থানার সাগরদাঁড়ী গ্রামে ১৮২৪ খ্রিঃ ২৫ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কলিকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিদ্রোহী কবি হিসেবেও তিনি পরিচিত। কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। মহাকবি বাংলা সাহিত্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক, আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কালজয়ী রচনাবলীর অন্যতম হলো- মেঘনাদবধ কাব্য, Captive Lady,শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী, বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রোঁ, তিলোত্তমা সম্ভব, বীরাঙ্গণা ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
- ছদ্মনাম: টিমোথি পেনপোয়েম
- সাহিত্য আন্দোলন: বাংলার নবজাগরণ
- মাইকেল নাম কিভাবে যুক্ত হল : অনেকে মনে করেন, বিশেষত ইংল্যান্ডপ্রীতির কারণেই কবি মধুসূদন ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন; বিয়েও করেছিলেন খ্রিস্টান নারীকে। ধর্ম পরিবর্তন করে তিনি নামের আগে মাইকেল শব্দটি যুক্ত করেন।
- বাণী চিরন্তনী : জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা হবে?
শেখ মোহাম্মদ সুলতান, (১০ আগস্ট ১৯২৩ - ১০ অক্টোবর ১৯৯৪) যিনি এস এম সুলতান নামে সমধিক পরিচিত, ছিলেন একজন বাংলাদেশী প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী। তার জীবনের মূল সুর-ছন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং কৃষিকাজের মধ্যে। আবহমান বাংলার সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য, দ্রোহ-প্রতিবাদ, বিপ্লব-সংগ্রাম এবং বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তার শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। তার ছবিতে গ্রামীণ জীবনের পরিপূর্ণতা, প্রাণপ্রাচুর্যের পাশাপাশি শ্রেণির দ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির হালও অনেকটা ফুটে উঠেছে। তার ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে গ্রামের মহিমা উঠে এসেছে এবং কৃষককে এই কেন্দ্রের রূপকার হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
- পুরস্কার : এস.এম.সুলতান একুশে পদক, চারুশিল্পী সংসদ সম্মান ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার পেয়েছেন।
- উল্লেখ্য স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার বা স্বাধীনতা পুরস্কার বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক।
- অন্যান্য নাম : লাল মিয়া।
- বাড়ী : নড়াইল, চিত্রা নদীর পাড়ে।
- সমাধি: নড়াইল।
তিনি ছিলেন যশোর কালেক্টরেট অফিসের একজন সামান্য কেরানী। ১৯১০সালে হ্যালির ধূমকেতু পপর্যবেক্ষণ করলেন অনেকদিন। অভ্যাসমত একটি খাতায় তিনি তার পর্যবেক্ষণ লিখে রাখতেন। পরে এই নিয়ে লিখলেন একাধিক প্রবন্ধ। দিনভর চাকুরী আর রাত হলেই ধৈর্য্য ধরে আকাশ পর্যবেক্ষণ। রাতের পর রাত অসীম ধৈর্য্যের সংগে পরিশ্রম করে তিনি গড়ে তুললেন এক অমূল্য তথ্য ভান্ডার। রাধাগোবিন্দের সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করতো সেই কালের ইউরোপ আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমন্দির, আমেরিকান এ্যাসোসিয়েশন অব ভ্যারিয়েবল স্টার অবজার্বার, লন্ডনের ব্রিটিশ অ্যাষ্টোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন ফ্রান্সের লিয় মানমন্দির প্রভৃতি। রাধাগোবিন্দের পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথ্য প্রকাশপেতো এসব মানমন্দির প্রকাশিত পত্র- পত্রিকায়। হার্ভার্ডে এখনও তার পর্যবেক্ষণ লব্ধ তথা সযত্নে রক্ষিত আছে। হার্ভার্ড মানমন্দির কর্তৃপক্ষ ১৯২৬ সালে সেই সূদর আমেরিকা থেকে যশোরের ঐ পাড়াগায়ে ছ’ইঞ্চি ব্যাসের একটি দূরবীণ পাঠিয়ে দেন এবং সাথে মানমন্দিরের ডিরেক্টরের কৃতজ্ঞতাপত্র। ফরাসি সরকার পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সম্পর্কে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯২৮ সালে রাধাগোবিন্দ OARF (Officer of Academic Republiance frencaise) সম্মানসূচক উপাধি ও পদক প্রদান করেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর রাধাগোবিন্দ কলকাতা চলে যান।
চৌগাছা থানার সিংহঝুলি গ্রামে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে ২৩ এপ্রিল শহীদ হন। শহীদ মোঃ মশিউর রহমান যশোর তথা বাংলাদেশের একটি পরিচিত নাম। দেশের স্মরণীয় ও বরণীয় একজন। আধুনিক মনন ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় একজন নিবেদিত সাহসী নেতার নাম। ১৯৩৬ সালে যশোর জেলা স্কুল হতে এন্ট্রান্স, ১৯৩৮ সালে কলকাতা ইসলামীয়া কলেজ হতে আইএ এবং ১৯৪০ সালে বিএ পাশ করে ১৯৪৪ সালে কলকাতা লর্ড রিপন কলেজ হতে ল‘ ডিগ্রী অর্জন করেন। উপমহাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ব্যারিষ্টার হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দির সংস্পর্শে আসেন এবং একান্ত বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে সাবেক পাকিস্তানের শেষ নির্বাচনে জনাব মশিউর রহমান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে সাবেক পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং শেরে বাংলা ফজলুল হকের মন্ত্রীসভায় বিচার ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। পাকিস্তান সরকার ১৯৭১ সালে তাঁকে নিয়ে সংকিত ছিলেন। তাই ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাথে তাঁকেও ঐ রাতে গ্রেফতার করে এবং যশোর সেনানিবাসে একমাস আটক রেখে পৈশাচিক নির্যাতন চলে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যশোর পৌর উদ্যানে ১৯৭২ সালের ২৬ ডিসেম্বর শহীদ মশিউর রহমানের স্মৃতিসৌধের ফলক উন্মোচন করেন।
যতীন্দ্রনাথ মূখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন )
১৮৭৯ সালে কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৫ সালে ১০ সেপ্টেম্বর মারা যান। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে (স্বরাজ থেকে স্বাধীনতা) যে ক’জন অসীম সাহসী বিপ্লবী জড়িত ছিলেন, যতীন্দ্রনাথ মূখোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম। ডাকনাম বাঘা যতীন। রাখেন ডাঃ সুরেষ প্রসাদ রায়। বাঘ শিকারে যান, বাঘকে গুলি করলে ক্ষিপ্তবাঘ লাফ দিয়ে যতীন্দ্রনাথ মূখোপাধ্যয়ের ঘাড়ে এসে পড়ে। তিনি বাঘকে কাবু করে ছোরা দিয়ে হত্যা করেন। ঘটনা শুনে ডাক্তার সাহেব প্রেসকিপসনে নাম লেখেন বাঘা যতীন। দীর্ঘ ও সুঠাম দেহের অধিকারী যতীন্দ্রনাথ মূখোপাধ্যয় বাইরের চেয়ে ভিতরে ছিলেন কঠিন, কঠোর ও অকুতোভয়। উপমহাদেশের বিপ্লবী খাতায় তার নাম পরিচিতি পায়।
শিক্ষাবিদ আব্দুর রউফ :
১৯০২ সালের ২ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার নারায়নপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। (১৯০২-১৯৭১) ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল পাক সেনারা গুলি করে হত্যা করে। ১৯১৯ সালে কলিকাতা হতে তিনি প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস পাশ করেন। তিনি কৃতিত্বের সাথে আই,এ বি, এ এবং বি,টি পাশ করেন। কলিকাতা ক্যাম্বেল মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যায়ন কালে এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি বিশ্বাস হারাইয়া শেষবর্ষে তিনি কলেজ ত্যাগ করে ইউনিপ্যাথি চিকিৎসা নামে এক আদর্শ চিকিৎসা ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন। শিক্ষা- জীবন শেষকালে তিনি কলিকাতা মডেল হাইস্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তাঁর লিখিত বইগুলির অধিকাংশই এই সময়ের। বইগুলির মধ্যে আছে পথের ডাকে, অগ্র-সেতার। তিনি পাকিস্তান লেখক সংঘের আজীবন সদস্য ছিলেন।
যশোর কবে স্বাধীন হয়েছে?
১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর যশোর স্বাধীন হয়। উল্লেখ্য যশোর বাংলাদেশের প্রথম শত্রুমুক্ত জেলা/প্রথম স্বাধীন জেলা।
যশোর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত?
যশোর জেলা খেজুরের গুড়, খই ও জামতলার মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। যশোর নামের সাথে জড়িয়ে ছিল চিরুনির ঐতিহ্য। বৃটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনকে উপহার দেয়া হয়েছিল যশোরের চিরুনি। বড়ই প্রীত হয়েছিলেন তিনি। ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ তাঁর মেয়ের নামে চিরুনির নামকরণ করা হয়েছিলো ‘ইকলিস’।
তাছাড়া যশোর জেলাটিকে বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী বলা হয়। যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে ফুলের রাজ্য গড়ে ওঠার কারণে এমন বলা হয়। যশোর জেলা শহর থেকে বেনাপোলের দিকে ১৮ কিলোমিটার এগোলেই গদখালী বাজার।
যশোর জেলার চিত্তাকর্ষক স্থান ও স্থাপনাসমূহ :
১. চাঁচড়া শিব মন্দির।
২. চাঁচড়া জমিদার বাড়ি
৩. মুড়লির জোড়া শিবমন্দির
★যশোর পৌরসভার অন্তর্গত মুরলীতে যশোর খুলনা মহাসেকের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত ঐতিহাসিক জোড়া শিব মন্দির। সেন রাজবংশের সর্বশেষ রাজা ছিলেন লক্ষ্মণ সেন। তিনি শিব ভক্ত পরায়ণ নৃপতি ছিলেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন কর্তৃক বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে যশোর জেলার মুরলী গ্রামের জোড়া শিব মন্দির দুটি খুবই মনোরম। রাজা লক্ষ্মণ সেন শিব ভক্ত প্রজাদের জন্য ভৈরব নদের পশ্চিম তীরে ১১৮৯ খ্রীষ্টাব্দে পাশাপাশি এই মন্দির দুইটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের মধ্যে বেদীর উপর স্থাপন করেন যোগাসনে অধিষ্ঠিত প্রস্তর নির্মিত শিব(মহাদেব) মূর্তি। পাশে শুয়ে আছে বৃষভ বা বলদ। সেই হিসাবে মন্দিরের বয়স হয় প্রায় ৮২৩ বছর। এত বৎসর পার হলেও নির্মাণ শৈলী এত মজবুত এবং স্থানীয় জনগণের রক্ষা করার কারণে সেই প্রমাণে ক্ষয় প্রাপ্ত হয়নি। মন্দিরের অদূরে পূজারীর বসবাসের স্থান, সম্মুখে ভক্তদের অনুষ্ঠানের জন্য ছিল বৃহৎ খোলা চত্বর। প্রতিষ্ঠিত মন্দিরের সম্পত্তি দেবোত্তর হিসাবে রেকর্ডভুক্ত হয়। মন্দির দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য বহন করে। এর নির্মাণ কুশলতা অতীব দৃষ্টিনন্দন। এই মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৪০ ফুট, ১৫ ফুট করে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ। চুড়ায় ত্রিশুল, তার নিচেই ১টিতে গণেশ, একটিতে শিব, লাইন ধরে যুক্ত চড়াই এবং টিয়া পাখি, কারুকার্য খচিত দরজা ২টি প্রায় পূর্বমুখী এবং অপর ২টি প্রায় উত্তর ও দক্ষিণমুখী। দরজার উপর লড়াই করছে ২টি অশ্ব এবং সুদৃশ্য পদ্ম। মন্দির দুটি কোনার্কের (উড়িষ্যায়) সূর্য্য মন্দিরের সাথে তুলনীয়। মন্দিরের গায়ে লেখা আছে ১১৮৯ ইং সন।
৪.ফুলের হাট গদখালি
৫. সাগরদাড়ী, বাংলা পদ্যর জনক ও মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত-এর বাড়ি
৬. তাপস কুটির (কাস্টমস অফিস)
৭. বেনাপোল স্থল বন্দর
৮. যশোর ইন্সটিটিউট
৯. যশোর ইন্সটিটিউট পাবলিক লাইব্রেরী
১০.যশোর বিমানবন্দর
১১. যশোর সেনানিবাস
১২. শ্রীধরপুর জমিদার বাড়ি
১৩. বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখের সমাধি
১৪. মীর্জানগর হাম্মামখানা
১৫.হাজী মুহম্মদ মু্হসীনের ইমামবাড়া বা মুড়লির ইমামবাড়া (*স্থানীয় নাম : মুড়লির ইমামবাড়া)
★ উল্লেখ্য পিতার নাম হাজী ফাইজুল্লাহ এবং মাতার নাম জয়নাব খানম। এটি ছিলো জয়নব খানমের দ্বিতীয় বিবাহ। তার প্রথম স্বামী আগা মোতাহার বিশাল ধন সম্পত্তির মালিক ছিলেন পরে যার মালিক হন তার একমাত্র কন্যা মন্নুজান খানম। সৎ ভাইবোন হলেও মন্নুজান হাজীকে আপন ভাই এর মতোই স্নেহ করতেন। ১৮০২ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা ও নিঃসন্তান মন্নুজান তাঁর সমস্ত সম্পত্তি লণ্ডন কোর্টের মাধ্যমে হাজীক দেন।
*পরবর্তীতে হাজী তার সমস্ত সম্পত্তি দান করেন। হাজী দানবীর নামে পরিচিত। বলা হয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দানবীর হাজী।
*মহসীন হল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহসীন হল তাঁর স্মরণে প্রতিষ্ঠিত।
*মন্নুজান হল
এইহল স্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রথম আবাসিক হল। দানবীর হাজি মুহাম্মদ মহসিনের বড় বোন বেগম মন্নুজানের নামানুসারে নামকরন করা হয় “মন্নুজান হল”।
১৬.মনিহার সিনেমা হল
★ মণিহার সিনেমা হল (বা সংক্ষেপে মনিহার) যশোর জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তম সিনেমা হল।[১৯৮৩ সালের ৮ ডিসেম্বর এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর জন্য প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই সিনেমা হলটি খ্যাতি অর্জন করে।জাপান, কোরিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ থেকে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা মণিহারে আসতেন চলচ্চিত্র দেখার জন্য। বাংলাদেশি চলচ্চিত্র শিল্পে মণিহার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে।
* শিল্পী এস.এম.সুলতান এর তত্তাবধানে হলটির নির্মাণ পরবর্তী সাজসজ্জার কাজ সম্পন্ন করা হয়।
* মনিহার সিনেমা হল প্রথম থেকেই শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত।
১৭. কালেক্টরেট পার্ক
১৮. লালদীঘির পাড় (বর্তমানে লালদীঘির পাড়ে মসজিদ অবস্থিত, যা লালদীঘির পাড় জামেমসজিদ নামে পরিচিত)
১৯.বিনোদিয়া পার্ক
২০.যশোর বোট ক্লাব
২১. ভরত রাজার দেউল (ভরত ভায়না)
২২. জেস গার্ডেন পার্ক
২৩. পৌর পার্ক
২৪. যশোর আইটি পার্ক/ শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক
★যশোর আইটি পার্ক যা (শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক) নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের যশোর জেলায় অবস্থিত প্রথম আইটি পার্ক। ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর উদ্বোধন করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। দেশের আইসিটি সেক্টরের বিকাশে যশোরে যাত্রা শুরু করেছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। ১০ই ডিসেম্বর, ২০১৭ইং গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই আইটি পার্কের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে দেশের আইসিটি সেক্টরে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার উন্মোচিত হলো।
২৪. মীর্জা নগর নবাব বাড়ি
২৫. ভাতভিটা
যশোর জেলাটি আমাদের দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এর একটি অঞ্চল, এটি খুলনা বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। আয়তনে এ জেলাটি প্রায় ২৬০৬.৯৪ বর্গ কিমি। যশোরের পশ্চিমে রয়েছে ভারত, পূর্বে রয়েছে নড়াইল জেলা, দক্ষিনে অবস্থিত খুলনা জেলা এবং উত্তরে অবস্থিত যথাক্রমে ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলা।
মোট ৮টি উপজেলা নিয়ে এ জেলাটির প্রশাসনিক কার্যক্রম বিস্তৃত।
শিক্ষা :
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সময় হতেই যশোর শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠান আছে এ জেলায়। যশোরে নির্মিত হচ্ছে "শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক"। এছাড়া উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিচে দেয়া হলোঃ
১.যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (JUST)
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ইংরেজি: Jashore University of Science & Technology) বাংলাদেশের যশোর জেলায় অবস্থিত প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারি এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। এটি খুলনা বিভাগের চতুর্থ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ।
২. ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক মিউনিসিপ্যাল কলেজ, যশোর
৩. যশোর মেডিকেল কলেজ
৪. যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ
৫. বি এ এফ শাহীন কলেজ,
৬. সরকারী এম. এম. কলেজ সরকারী মাইকেল মধুসুদন কলেজ-১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে
৭. যশোর পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট
৮. যশোর জিলা স্কুল-১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে
৯. যশোর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় -১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে
১০. সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন যশোর-১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে
১১. দাউদ পাবলিক স্কুল
১২. যশোর শিক্ষা বোর্ড মডেল স্কুল এন্ড কলেজ
১৩. বিমান বাহিনী একাডেমী, বাংলাদেশের একমাত্র বিমান বাহিনী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
১৪. হামিদপুর আল-হেরা কলেজ,যশোর
১৫. যশোর আমিনিয়া কামিল মাদরাসা
১৬. যশোর সরকারি সিটি কলেজ
১৭. মশিয়াহাটী ডিগ্রী কলেজ
১৮. মশিয়াহাটী বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয়
১৯. নওয়াপাড়া মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়
২০. আকিজ কলেজিয়েট স্কুল
২১. মণিরামপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়
২২. মণিরামপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়
২৩. চাড়াভিটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় -১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে
২৪. মনিরামপুর কারিগরি ভোকেশনাল ইন্সটিটিউ,
২৫. রায়পুর স্কুল এন্ড কলেজ, বাঘারপাড়া
২৬. কয়ালখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিয়ালপাড়া
২৭. মনিরামপুর কলেজ,
২৮. মনিরামপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ,
২৯. বরভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয়,বাঘারপাড়া
৩০. বাঘারপাড়া পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়,বাঘারপাড়া
৩১. ঝিকরগাছা এম.এল মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় ঝিকরগাছা, যশোর ১৮৮৮ সালে
৩২. ঝিকরগাছা বি এম মাধ্যমিক বিদ্যালয়
৩৩. চৌগাছা কামিল মাদ্রাসা
৩৪. চৌগাছা শাহাদৎ পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যারয়,
৩৫. চৌগাছা হাজী সরদার মর্ত্তজ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়,
৩৬. চৌগাছা সরকারী কলেজ,
৩৭. চৌগাছা মৃধাপাড়া মহিলা কলেজ,
৩৮. এবিসিডি কলেজ(অবস্থিত :চৌগাছা)
★যশোরের নিভৃত পল্লীর চার গ্রামের নামের আদ্যাক্ষরে নামকরণ করা হয় এবিসিডি কলেজ। ২০০০ সালে যশোরের চৌগাছা উপজেলার আরাজি সুলতানপুর, বকসিপুর, চাকলা ও দেবীপুর মানুষের সহযোগিতায় এলাকার শিক্ষানুরাগীরা এগিয়ে আসেন আলোর মশাল জ্বালাতে ও কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৩৯.এস এম হাবিব কলেজ,
৪০. ভবদহ মহাবিদ্যালয়
শিক্ষার হার :
শিক্ষার হার. ৫৬.৫২% (২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী সাতবছর এবং তার বেশী বয়সের মানুষের শিক্ষার হার).
নদী :
১. ভৈরব নদ
ভারতে গঙ্গার শাখা নদী জলাঙ্গি থেকে ভৈরবের উৎপত্তি। ভারত বহু বছর আগে রেগুলেটর তৈরি করে ভৈরবের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে।
২. কপোতাক্ষ নদ
কপোতাক্ষ নদ ভৈরব নদের একটি শাখানদী।
* কপোতাক্ষ নদ কবিতাটি মাইকেল এই নদের স্মরণেই রচনা করেছিলেন।
অর্থনীতি :
চিংড়ি চাষ :
যশোরের অথনীতিকে বেগবান করেছে মাছ চাষ। যশোরের অর্থনীতির সিংহভাগই আসে মাছ চাষ তথা চিংড়ি রফতানি করে।
বেনাপোল স্থল বন্দর :
যশোরের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেনাপোল স্থল বন্দর যা শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বেনাপোলে অবস্থিত। ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের সিংহভাগ এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়। ওপারে আছে পেট্রাপোল। সরকারি আমদানী শুল্ক আহরণে বেনাপোল স্থল বন্দরটির ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। এখানকার মানুষের জীবিকার অন্যতম সূত্র বেনাপোল স্থল বন্দরের কাস্টমস্ ক্লিয়ারিং এজেন্টের কাজ ।বেনাপোল সম্পর্কে আরো জানতে পারবেন বেনাপোল প্রতিদিন অনলাইন নিউজ পোর্টালে।
নওয়াপাড়া :
যশোরের ব্যবসা বাণিজ্যর প্রাণ কেন্দ্র বলা যায় নওয়াপাড়াকে। এখানকার এবং আশেপাশের উদ্যোক্তাদের কারণে এখানে বিভিন্ন শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া নৌপথে আমদানি রপ্তানি হয়ে থাকে। যা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে ।
গদখালি:
বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী যশোর। বাংলাদেশের অধিকাংশ ফুল মূলত যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালিতে চাষ হয়। এখানে উৎপাদিত ফুল সারাদেশে সরবরাহ করা হয়।
যশোর রোড :
বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে সরাসরি সংযোগ সৃষ্টিকারী সড়ক হিসেবে ‘যশোর রোড’ সকলের কাছেই পূর্ব পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধে যশোর রোড :
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানীরা এদেশে হামলা করলে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশী জনগণ অস্থায়ী শরণার্থী হিসেবে ভারতে গমন করে। সে সময় নিরাপদে ভারতের ভূখণ্ডে অস্থায়ীভাবে প্রবেশের পথ হিসেবে শরণার্থীরা বেছে নেয় এই যশোর রোডকে এবং তল্পিতল্পা গুছিয়ে রওনা দেয়।
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড :
বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে যশোর রোডকে আন্তর্জাতিকীকরণের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। একাত্তরে তিনি এসেছিলেন কলকাতা সফরে। উঠেছিলেন আরেক বিখ্যাত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে। কলকাতা থেকে যশোর রোড কাছে হবার ফলে দেখতে চেয়েছিলেন শরণার্থী ক্যাম্পগুলো। সেপ্টেম্বরে রওনা দেন সীমান্তের উদ্দেশ্যে। কিন্তু অতিবর্ষণের ফলে যশোর রোড তখন সম্পূর্ণ ভাসমান। নৌকা ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না তার হাতে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও পিছু হটেননি কবি। নৌকাযোগে পৌঁছান যশোর সীমান্তে। এ প্রসঙ্গে কবিতা ও গানের খবরাখবর নিয়ে বব ডিলানের প্রকাশনা ‘ডিলান ১০’ এর বসন্ত সংখ্যায় গিন্সবার্গ লিখেন,
“আমার ইচ্ছা ছিল, বব ডিলানকে চমকে দিয়ে একটা গান লিখব। অনেকটা উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের ‘স্যাড-আইড লেডি অব দ্য লো ল্যান্ডস’-এর মতো লম্বা কোনো গান, যা প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মানবিক আকুতি জাগাবে, যা ডিলানকে ভাবাবে, কাঁদাবে। আমি তা-ই লিখতে চেষ্টা করলাম। সম্প্রতি কলকাতা ঘুরে লাখ লাখ মানুষের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট দেখে আমার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে, তা-ই লিখলাম। কলকাতার ভাষা আর সংগীতের মিশ্রণে সেটিকে গানে রূপ দিলাম ভারতীয় হারমোনিয়াম সহযোগে। সে সময়ে দেখা মানুষগুলোর অন্তহীন যাতনা আমাকে নির্বাক করেছিল। সব বয়সের মানুষের বেঁচে থাকার কষ্ট আমার বুকে চেপে বসে ছিল। সেই যাতনা হৃদয়ে নিয়েই আমি লিখেছিলাম ‘যশোর রোড’ কবিতা”।
Millions of souls nineteen seventy one
homeless on Jessore road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan
Taxi September along Jessore Road
Oxcart skeletons drag charcoal load
past watery fields thru rain flood ruts
Dung cakes on tree trunks, plastic-roof huts
Wet processions Families walk
Stunted boys big heads don’t talk
Look bony skulls & silent round eyes
Starving black angels in human disguise.
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতাটির লাইনগুলো নিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গমনের পর পপ সঙ্গীতের কিংবদন্তী বব ডিলান তার কাছ থেকে কবিতাটি নিয়ে যান পড়ে দেখবার জন্যে। ফেরত দেবার সময় লেখাটি পড়ে নিজের অশ্রু বিসর্জনের কথাও উল্লেখ করেন বব। এরপর শুরু হয় এর সংগীত প্রযোজনা করে গিটারের সুরে দাঁড় করানোর চেষ্টা। হারমোনিয়ামের সুর থেকে গানটিকে গিটারের সুরে নিয়ে আসতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল বব ডিলানকে। সকল ক্লান্তিকে পেছনে ফেলে একপর্যায়ে গানটি পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত হয়। মার্কিন কবি ও সাংবাদিক জন সিনক্লেয়ারের মুক্তির দাবিতে আয়োজিত এক শোভাযাত্রায় গানটি করেন অ্যালেন গিন্সবার্গ। সেখান থেকে গানটি শুনে মুগ্ধ হন আরেক কিংবদন্তী জন লেনন। আর এভাবেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যশোর রোড আরও একবার পরিচিত হয়, হতে থাকে ইতিহাসের নির্মাতা।
নিউইয়র্কে যশোর রোড :
গত বছরের (২০১৭) অক্টোবরে নিউইয়র্কের কুইন্সে একটি প্রদর্শনীতে ‘যশোর রোড’ নামে একটি ভাস্কর্য প্রদর্শন করা হয়। প্রায় ৮০টি ভাস্কর্যের মধ্যে ‘যশোর রোড’ সহজেই সবার নজর কাড়ে। ভাস্কর আখতার আহমেদ রাশা তার ভাস্কর্যের মাধ্যমে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটিকে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেবার পাশাপাশি যশোর রোডের ইতিহাসে নতুন এক মাত্রা যুক্ত করেন।
বর্তমানে যশোর রোড :
বর্তমানেও যশোর রোড বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সংযোগ সড়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে বেনাপোল বন্দর পর্যন্ত সড়কটির প্রায় ৩৮ কিলোমিটার অংশ বাংলাদেশে পড়েছে। পেট্রাপোল থেকে কালীঘাট পর্যন্ত পড়েছে ভারতের ভূখণ্ডের মধ্যে। উভয় দেশের সড়কের সম্মিলিত অংশকে একত্রে বলা হয় যশোর রোড।
সড়কের দু’ধারের প্রায় আড়াই শত বছরের পুরনো আড়াই হাজারেরও বেশি বৃক্ষরাজি এখনো ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে যাচ্ছে। এসবের মধ্যে তিন শতাধিক মেঘ শিরীষ গাছও রয়েছে। ধারণা করা হয় প্রায়, ১৭৪ বছর আগে যশোরের তৎকালীন জমিদার কালী পোদ্দার মেঘ শিরীষ গাছগুলো রোপণ করেন।
শুধুমাত্র এই গাছগুলোর জন্যেই যশোর রোড অন্যরকম এক স্নিগ্ধতা বহন করে চলছে জনম জনম ধরে। একদিকে যেমন সবুজের সমারোহ অন্যদিকে ঐতিহাসিক গুরুত্ব; সবমিলিয়ে এ পথে ভ্রমণকারী এমন একজন ব্যক্তিও হয়তো নেই, যিনি এই গাছগুলোর প্রেমে পড়েননি।
সম্প্রতি যশোরের ইংলিশ বানান পরিবর্তন :
বাংলা নামের সঙ্গে মিল করতে দেশের পাঁচ জেলার ইংরেজি বানান ২০১৮সালের ২ এপ্রিল পরিবর্তন করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, বরিশাল,যশোর ও ,বগুড়ার নামের ইংরেজি বানান বাংলা উচ্চারণের মতো হলো।
পূর্বে যথাক্রমে এসব জেলার নামের ইংরেজি বানান ছিল Chittagong, Comilla, Barisal, Jessore ও Bogra.
এখন নতুন নিয়মে চট্টগ্রামের বানান Chattogram, কুমিল্লার Cumilla, বরিশালের Barishal, যশোরের Jashore ও বগুড়ার Bogura.
তথ্যসূত্র :
'' বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (জুন, ২০১৪)।
"এক নজরে যশোর"। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। জার্নি রিপোর্ট (২০১৮-১২-২৯)।
" সাঁকো থেকে যেভাবে 'যশোর' নামের উৎপত্তি"। বাংলা ট্রিবিউন।
" ৬৪ জেলার নামকরণের ইতিহাস"। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (জুন, ২০১৪)।
" জেলার পটভূমি"। jessore.gov.bd। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
হাসনাত, রাকিব (২০১৯-০১-১৫)। "যেভাবে ফুলের রাজ্যে পরিণত হলো যশোরের গদখালী" (ইংরেজি ভাষায়)।
"সনাতন গোস্বামী"। যশোর ডট ইনফো।
"রূপ গোস্বামী"। যশোর ডট ইনফো।
"শ্রীজীব গোস্বামী"। যশোর ডট ইনফো।
"সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার"। যশোর ডট ইনফো।
"জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ"। সমকাল। ১৬ জুলাই ২০১৬।
লেখক ঃ
স্রোতস্বিনী লামিসা
৩য় ব্যাচ , আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ
লেখক ঃ
স্রোতস্বিনী লামিসা
৩য় ব্যাচ , আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ
Comments
Post a Comment