গত শতাব্দীর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের রবার্ট গডার্ড উৎক্ষেপণ করেছিলেন প্রথম আধুনিক রকেট। সে রকেট অবশ্য মহাকাশে যায় নি, গিয়ে পড়েছিল বাধাকপি ক্ষেতে। তারপর পঞ্চাশের দশকে শুরু হয় রাশিয়া আর আমেরিকার আকাশ জয়ের প্রতিযোগিতা। স্নায়ুযুদ্ধের হাত ধরে এ লড়াইয়ে অবশ্য লাভবান হয় বিজ্ঞান ই। মানুষ আকাশ ছাড়িয়ে চলে যায় মহাকাশে, পাড়ি জমায় চাঁদেও। চাঁদের বুকে পা রাখার পর থেকে মানুষ স্বপ্ন দেখা শুরু করে একদিন তারা ও হেঁটে আসবে মংগলের বুক থেকে। আগের সব উদ্যোগ ই ছিল বিভিন্ন দেশের সরকারের। তাই স্বপ্ন পূরণের জন্য তাকিয়ে থাকতে হতো রাষ্ট্রযন্ত্রের দিকে। এ থেকে মুক্তি পেতে এ শতাব্দীর শুরুতে এগিয়ে এলেন আমাদের কালের এডিসিন বা আয়রন ম্যান খ্যাত ইলন রিভ মাস্ক। পে প্যাল বিক্রির পর পাওয়া ১৭ কোটি মার্কিন ডলার এর পুরোটাই বিনিয়োগ করে ২০০২ সালে গড়ে তুললেন স্পেস এক্স।
স্পেস এক্স (Space X) এর পূর্নরূপ হচ্ছে “স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস কর্পোরেশন”। এটি ক্যালিফোর্নিয়ার হ্যাথ্রোনে অবস্থিত একটি এরোস্পেস নির্মাতা এবং স্পেস ট্রান্সপোর্টেশন নিয়ন্ত্রনকারী সংস্থা। একসময় যা কেবল ৬০ জন কর্মচারী নিয়ে শুরু হয়েছিল আজ সেখানে বর্তমানে প্রায় ৭০০০ কর্মচারী কাজ করছে। যেখানে নাসা (NASA), ভারতের ইসরো (ISRO - Indian Space Research Organisation), রাশিয়ার রসকসমস (Roscosmos) অন্যান্য গ্রহে জীবন রয়েছে কিনা, অন্যান্য গ্রহে পানি বা মানুষের থাকার অবস্থা আছে কিনা এসব গবেষনা নিয়ে ব্যাস্ত ; সেখানে স্পেস এক্স এর মূল লক্ষ্য কেবল স্পেস ট্রাভেল এবং স্পেস এক্সপ্লোরেশন এর খরচ কমিয়ে এনে স্পেস ট্রাভেলিংকে আরও সমৃদ্ধ করা। মূলত স্পেস এক্স মহাকাশ ভ্রমন সম্পর্কিত যাবতীয় সকল কিছুকে সকলের জন্য সস্তা করার কাজ করে যাচ্ছে।
শুরু থেকে যে লক্ষ্য নিয়ে স্পেস এক্স তৈরি হয়েছিল,আর আজ পর্যন্তও তারা সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে স্পেস এক্স ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে নানারকম কার্গো পাঠানো থেকে শুরু করে মহাকাশে উপগ্রহ স্থাপনের কাজ নিয়মিতভাবে করে যাচ্ছে। স্পেস এক্স দাবি করে যে, নাসা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যদি কেবল স্পেস ট্রাভেলিং নিয়ে ভালোভাবে কাজ করে তবে স্পেস ট্রাভেলিং এর খরচ প্রতি কেজিতে অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে আনা যাবে।
প্রথম দিকে স্পেস এক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক রাশিয়া থেকে কমদামে রকেট কিনে তা মডিফাই করে ব্যবহার করার চিন্তা করলেও ; পরিশেষে তিনি রাশিয়া থেকে তার কাঙ্খিত দামে রকেট কিনতে সক্ষম হননি উল্লেখ্য, রাশিয়ান রকেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আইএসসি কসমোট্রেজ ৮ মিলিয়ন ডলারে একটি পুরোনো রকেট বিক্রি করতে সম্মত হয়েছিল। অতঃপর ইলন মাস্ক এবং তার টীম এই সিদ্ধান্তে উপনিত হলেন যে তারা নিজেরাই রকেট তৈরি করবেন। আর সত্যি কথা বলতে আধুনিক রকেট ইন্ডাস্ট্রির জন্য এটি ছিল একটি বড় বিপ্লব। ইলন মাস্ক জানতেন যে একটি তৈরি রকেটের যে বিক্রয় দাম নির্ধারন করা হত ; তার তুলনায় কাচামাল বা Raw ম্যাটেরিয়াল এর দাম মাত্র ৩-৪%। সুতরাং তারা যদি রকেট না কিনে নিজেরা তৈরি করতে পারেন ; তবে কম দামে ভালো রকেট প্রস্তুত করতে পারবেন; পাশাপাশি সেই রকেট বিক্রয় করে ৭০% পর্যন্ত বেশি মুনাফাও অর্জন করে নিতে পারবেন। যেই কথা সেই কাজ ইলোন মাস্ক অতঃপর স্পেস এক্স এর ইনভেস্টরদের থেকে রকেট প্লান্ট বানানোর ইনভেস্টমেন্ট হাতে নেয়ারর পর স্পেস এক্স পুরোদমে কাজ করতে শুরু করে দেয়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি রকেট তৈরি করতে ৮৫% শতাংশ কাজ স্পেস এক্স নিজেরাই করে আসছে।
ছবি - ফ্যালকন হেভি
ইলন মাস্ক ঠিক করলেন তাদের প্রথম রকেট টির নাম হবে ফ্যালকন -১। স্টার ওয়ার্স ফ্র্যাঞ্চাইজের সিনেমা গুলোতে মিলেনিয়াম ফ্যালকন নামে যে স্টার শীপটি রয়েছে, সেখান থেকে এর নামকরণ হয়েছে। প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে স্পেস এক্সই একমাত্র যারা কিনা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে স্পেসক্রাফ্ট পাঠিয়েছে ; এতদিন যা করছিলো কেবল নাসা। স্পেস এক্সের এই স্পেসক্রাফ্টের নাম হল ড্রাগন ; আর তারা ২৫শে মে,২০১২ সালে নাসার একটি কার্গো ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে তাদের স্পেসক্রাফ্টের মাধ্যমে নিয়ে যায়। বর্তমানে স্পেস এক্স এর সবচাইতে ভালো রকেট হলো ফ্যালকন ৯ ; তবে অতিশীঘ্রই তাদের সবচেয়ে শক্তিসালী রকেট ‘ফ্যালকন হেভি’ মহাকাশ যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। বর্তমানে স্পেস এক্সের কাছে চার প্রকার রকেট ইঞ্জিন রয়েছে, এগুলো হলো: Merlin, Kestrel, Draco এবং SuperDraco।
ছবি - ড্রাগন ক্যাপসুল
ফ্যালকন সিরিজের সকল রকেটে সাধারনত Merlin রকেট ইঞ্জিনটি ব্যবহার করা হয়। আর ফ্যালকন রকেটের দ্বিতীয় স্টেজে সাধারনত Kestrel ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। আর ড্রাগন নামক স্পেসক্রাফ্টটিতে ব্যবহার করা হয় Draco ইঞ্জিনটি। আর Draco ইঞ্জিনটির আবার নতুন এবং শক্তিশালী ভার্সন বের হয়েছে যার নাম SuperDraco। তাছাড়াও স্পেস এক্স Rapter নামক একটি ইঞ্জিন ডেভেলপ করছে, যেটিকে আন্তঃপৃথিবী মহাকাশে ঘোরার জন্য একটি স্পেসক্রাফ্ট তৈরি করা হবে, তাতে ব্যবহার করা হবে। স্কেসএক্স এর স্পেসক্রাফ্ট ড্রাগন প্রথম স্টেজে একবার ২০১২ সালে ; আবার দ্বিতীয় স্টেজে তথা ২০১৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন ভ্রমন করে।
স্পেস এক্স এর মূল রকেট ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা মূলত স্পেস এক্সের এর প্রধান কার্যালর বা ক্যালিফোর্নিয়া তেই অবস্থিত। টেক্সাসে স্পেস এক্স এর একটি টেস্টিং স্টেশন রয়েছে ; আর এখানে তারা তাদের নতুন উদ্ভাবনকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখে। স্পেস এক্সের কাছে মোট ৪ টি স্পেসক্রাফ্ট এবং রকেট লঞ্চসাইট রয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে এদের একটি স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ও গবেষনাগার রয়েছে।
- · স্পেস এক্স একমাত্র প্রাইভেট কোম্পানি যারা মহাকাশে প্রথম রকেট পাঠিয়ে, তা আবার রিকভারও করেছিল।
- · স্পেস এক্স একমাত্র প্রাইভেট কোম্পানি যারা নিজেদের ফান্ডে লিকুইড ফিউলড রকেট মহাকাশে পাঠিয়েছিল।
- · স্পেস এক্স একমাত্র প্রাইভেট কোম্পানি যারা ইন্টারন্যাশানাল স্পেস স্টেশন পর্যন্ত কোনো প্রাইভেট স্পেসক্রাফ্ট নিয়ে গিয়েছিল।
- · স্পেস এক্সই একমাত্র কোম্পানি যারা ২০১২ সালে যে স্পেসক্রাফ্ট ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পাঠিয়েছিল ; একই স্পেস ক্রাফ্টে করে আবার দ্বিতীয় বারের মত ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে কার্গো বহন করে নিয়ে গিয়েছিল।
স্পেস এক্স এর মহাকাশ যানসমূহঃ
- · ট্রান্সপোর্ট রকেট ( স্যাটেলাইট ও স্পেসক্র্যাফট এর জন্য) - ফ্যালকন ৯
- · পৃথিবীর সবচাইতে শক্তিশালী রকেট - ফ্যালকন হেভি
- · স্পেসক্র্যাফট – ড্রাগন
এছাড়া বিগ ফ্যালকন রকেট (BFR) নামের নতুন একটি রকেট সিস্টেম তৈরী করছে, যেটি ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে মংগল গ্রহ কিংবা অন্য কোনো গ্রহ/উপগ্রহে মালামাল বা যাত্রী পরিবহন করা যাবে। এর পাশা পাশি ২০২৪ সালের মধ্যে মংগলে বসতি স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে স্পেস এক্স।
স্পেসএক্স ফ্যালকন ৯ উৎক্ষেপণ যানে করে ১১ মে ২০১৮ সফলভাবে বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হয়। এটি ফ্যালকন ৯ রকেটির নতুন ব্লক ৫ মডেল ব্যবহার করে প্রথম পেলোড উৎক্ষেপণ ছিল।
ইলন মাস্ক হয়তো নিজেও জানতেন না যে তার স্পেস এক্স রকেট কোম্পানী মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন, এবং হয়তো সত্যিই তাই ই, আমাদের এ প্রিয় পৃথিবীর প্রাণের অস্তিত্ব ধরে রাখা কঠিন হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়ত আর মাত্র কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত মানুষ এ পৃথিবীতে থাকতে পারবে। তারপর?
তথ্যসুত্র-
তথ্যসুত্র-
Comments
Post a Comment