দেশের
নাম - জাপান
রাজধানী
ও বৃহত্তর শহর - টোকিও
জাতীয়
ভাষা - জাপানি
সরকার -
এককেন্দ্রিক সংসদীয় সাংবিধানিক রাজতন্ত্র
সম্রাট -
(Naruhito) নারুহিতো রাজধানী
প্রধানমন্ত্রী
- শিনযো আবে
উপপ্রধানমন্ত্রী
- তারো আসো
আইনসভা -
কোক্কাই
উচ্চকক্ষ -
লোকসভা পরিষদ
নিম্নকক্ষ -
প্রতিনিধি পরিষদ
আয়তন -
৩, ৭৭,৯৪৪ বর্গ কিলোমিটার (১, ৪৫,৯২৫ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা -
১২৬,৯১৯,৬৫৯ (২০১৫
আনুমানিক) ( ১০ম)
জিডিপি (পিপিপি) (২০১৫ আনুমানিক)
মোট -
৪.৮৪৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন
ডলার (৪র্থ)
মাথাপিছু
আয় - ৩৮,২১৬-মার্কিন
ডলার (২৯ তম)
মুদ্রা -
ইয়েন
সময়
অঞ্চল – ইউটিসি +৯ (জাপান মান
সময়)
জাপানকে
বলা হয় ‘নিশীথ সূর্যের
দেশ’। প্রযুক্তির জগতে
শীর্ষস্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে দেশটি। এটি পূর্ব এশিয়ার
একটি দ্বীপ রাষ্ট্র এবং সাংবিধানিক রাজতন্ত্র।
জাপান (জাপানি: নিপ্পন বা নিহন; পুরো
নাম নিপ্নন-কোকু বা নিহন-কোকু, "জাপান রাষ্ট্র")হল পূর্ব এশিয়ার
একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। যে কাঞ্জি অনুসারে
জাপানের নামটি এসেছে, সেটির অর্থ "সূর্য উৎস"। জাপানকে প্রায়শই
"উদীয়মান সূর্যের দেশ" বলে অভিহিত করা
হয়।
জাপানের জনসংখ্যা ১২৬ মিলিয়ন। জনসংখ্যার
হিসেবে এটি বিশ্বের ১০ম
বৃহত্তম রাষ্ট্র। জাপানের রাজধানী টোকিও শহরের জনসংখ্যা প্রায় ৯.১ মিলিয়ন।এই
শহরটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার
২য় বৃহত্তম মূল শহর। টোকিও
ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্য নিয়ে গঠিত বৃহত্তর টোকিও
অঞ্চলের জনসংখ্যা ৩৫ মিলিয়নেরও বেশি।
এটি বিশ্বের বৃহত্তম মহানগরীয় অর্থনীতি।
জাপান
জাতিসংঘ, জি-৭, জি৮
ও জি২০ গোষ্ঠীগুলির সদস্য।
এই রাষ্ট্রটি একটি মহাশক্তিধর রাষ্ট্র।
নামমাত্র মোট আভ্যন্তরিণ উৎপাদন
অনুযায়ী জাপান বিশ্বের ৩য়-বৃহত্তম অর্থনীতি
এবং ক্রয়ক্ষমতার সাম্য অনুযায়ী ৪র্থ-বৃহত্তম অর্থনীতি।
এছাড়া জাপান বিশ্বের ৫ম-বৃহত্তম রফতানিকারক
এবং ৫ম বৃহত্তম আমদানিকারক
রাষ্ট্র। সরকারিভাবে জাপান যুদ্ধ ঘোষনার অধিকার বর্জন করলেও এই দেশটি একটি
আধুনিক সামরিক বাহিনী রেখেছে। এদেশের সামরিক বাজেট বিশ্বের ৮ম বৃহত্তম সামরিক
বাজেট।অবশ্য জাপানের সামরিক বাহিনীর কাজ হল আত্মরক্ষা
ও শান্তিরক্ষা। জাপান একটি উন্নত দেশ।
এখানে জীবনযাত্রার মান ও মানব
উন্নয়ন সূচক উচ্চ। সারা
বিশ্বের মধ্যে এই দেশে গড়
আয়ু সর্বাধিক এবং শিশু মৃত্যুর
হার তৃতীয় সর্বনিম্ন।দেশীয় তরবার সূচকে জাপানের স্থান প্রথম। বিশ্বশান্তি সূচকে এই রাষ্ট্রের স্থান
সর্বোচ্চ।
জাপানের
ইতিহাস
জাপান
দ্বীপপুঞ্জে মানুষ প্রথম বসতি স্থাপন করে
প্রাগৈতিহাসিক কালে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে জাপানের আদি জোমোন সংস্কৃতি
(যার নামকরণ হয়েছে স্বতন্ত্র "দড়ির দাগ দেওয়া" মাটির
বাসন থেকে) ক্রমশ য়ায়োই সংস্কৃতির দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। য়ায়োই
যুগে মূল এশীয় ভূখণ্ড
থেকে জাপানে নতুন প্রযুক্তির আগমন
ঘটেছিল। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে চীনের হান গ্রন্থে জাপানের
প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে অষ্টম শতাব্দীর
মধ্যে জাপানের বহুসংখ্যক রাজ্য ও উপজাতিসমূহ একটি
কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার অধীনে একত্র হয়, যার প্রশাসনিক
প্রধান হন সম্রাট। এই
সময়ে প্রতিষ্ঠিত জাপানের রাজবংশ আজ অবধি নিরবচ্ছিন্নভাবে
জাপান শাসন করে আসছে।
৭৯৪ খ্রিঃ হেইআন-ক্যো (আধুনিক কিয়োতো) শহরে নতুন রাজধানী
স্থাপন হয়; এই ঘটনা
হেইআন যুগের সূচনা নির্দেশ করে। ১১৮৫ খ্রিঃ
পর্যন্ত এই যুগ স্থায়ী
হয় এবং একে জাপানের
ধ্রুপদী সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ বলে গণ্য করা
হয়। এই সময় থেকে
জাপানের ধর্মবিশ্বাসে কোরিয়া থেকে আগত বৌদ্ধধর্ম
এবং জাপানের নিজস্ব শিন্তো ধর্মের এক মিশ্রণ লক্ষ্য
করা যায়।
পরবর্তী
শতাব্দীগুলিতে সম্রাট ও তার পার্ষদদের
ক্ষমতা ক্রমশ খর্ব হয় এবং
বিভিন্ন সামরিক গোষ্ঠী ও তাদের অনুগত
সামুরাই যোদ্ধারা দেশের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন। ১১৮০-৮৫ খ্রিঃ গেন্পেই যুদ্ধে মিনামোতো
নো য়োরিতোমোর নেতৃত্বে মিনামোতো গোষ্ঠী জয়লাভ করে। ক্ষমতা দখলের
পর য়োরিতোমো কামাকুরায় তার রাজধানী স্থাপন
করেন এবং শোগুন উপাধি
নেন। ১২৭৪ এবং ১২৮১
খ্রিঃ দু'বার কামাকুরা
শোগুনতন্ত্র মঙ্গোল আক্রমণ প্রতিহত করে। কিন্তু ১৩৩৩
খ্রিঃ শোগুন পদের এক প্রতিদ্বন্দ্বী
দাবিদারের কাছে তারা পরাস্ত
হলে মুরোমাচি যুগ আরম্ভ হয়।
মুরোমাচি যুগে শোগুনের ক্ষমতা
হ্রাস পায় এবং তার
অধীনস্থ স্থানীয় যোদ্ধা-নেতারা ক্ষমতা বহুলাংশে কুক্ষিগত করেন। এই যোদ্ধা-নেতাদের
ডাইমিয়ো বলা হত। ক্রমশ
জাপানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ষোড়শ শতাব্দীর
শেষভাগে জনৈক দাইমিও ওদা
নোবুনাগা ও তার উত্তরাধিকারী
তোয়োতোমি হিদেয়োশির নেতৃত্বে জাপানের রাজনৈতিক সংহতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫৯৮ খ্রিঃ
হিদেয়োশির মৃত্যুর পর তোকুগাওয়া ইএয়াসু
ক্ষমতা লাভ করেন এবং
সম্রাট কর্তৃক শোগুন পদে নিযুক্ত হন।
তোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্রের রাজধানী ছিল এদো (বর্তমান
তোকিও) শহরে এবং এই
শোগুনতন্ত্রের শাসনকাল এদো যুগ (১৬০০-১৮৬৮) ছিল আপেক্ষিকভাবে সমৃদ্ধ
ও শান্তিপূর্ণ। তোকুগাওয়া শোগুনতন্ত্র জাপানের সমাজে কঠোর জাতিভেদ প্রতিষ্ঠা
করে এবং অবশিষ্ট বিশ্বের
সাথে জাপানের সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
পুরাতাত্ত্বিক
গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে
যে উচ্চ প্যালিওলিথিক যুগেও
জাপানে জনবসতির অস্তিত্ব ছিল। জাপানের প্রথম
লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় ১ম
শতাব্দীতে রচিত চীনা ইতিহাস
গ্রন্থগুলিতে। জাপানের ইতিহাসে অন্যান্য বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাব দেখা যায়। এই
দেশের ইতিহাসে প্রথমে চীনা সাম্রাজ্যের প্রভাব
পড়েছিল। তারপর একটি বিচ্ছিন্নতার যুগ
কাটিয়ে এই দেশের ইতিহাসে
পড়ে পশ্চিম ইউরোপের প্রভাব।১৮৫৩-৫৪ খ্রিঃ মার্কিন
পেরি অভিযান জাপানের সচেতন বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটায়। এরই পরোক্ষ ফল
হিসেবে শোগুনতন্ত্রের পতন হয় এবং
১৮৬৮ খ্রিঃ পুনরায় সম্রাটের ক্ষমতায়ন হয়। এইভাবে শুরু
হওয়া মেইজি যুগের নব্য জাতীয় নেতৃত্ব
জাপানকে একটি বিচ্ছিন্ন, অনুন্নত
দ্বীপরাষ্ট্র থেকে সাম্রাজ্যে পরিণত
করে। পাশ্চাত্য নকশা অনুসরণ করে
জাপান এই সময় অন্যতম
বিশ্বশক্তি হয়ে ওঠে। এই
সাম্রাজ্যে সম্রাট জাতির দিব্য প্রতীকের সম্মান পান। ১৯শ শতাব্দীর
শেষভাগে এবং ২০শ শতাব্দীর
প্রথম ভাগে জাপান প্রথম
চীন-জাপান যুদ্ধ, রুশ-জাপান যুদ্ধ
ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করে। এই ক্রমবর্ধমান
সামরিক যুগে জাপান নিজ
সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত করে। তাইশো যুগে
(১৯১২-২৬) জাপানে গণতন্ত্রের
আগমন ঘটলেও জাপানি সেনাবাহিনীর অনিয়ন্ত্রিত স্বায়ত্তশাসন ছিল, আর তারা
১৯২০ ও ৩০ এর
দশকে নাগরিক নেতৃত্বকে নিয়মিত উপেক্ষা করত। ১৯৩১ এ
জাপানি সেনাবাহিনী মাঞ্চুরিয়া অধিকার করে, এবং ১৯৩৭
থেকে চীনের সাথে জাপানের দীর্ঘস্থায়ী
যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ১৯৪১ এর
ডিসেম্বরে পার্ল হারবার আক্রমণের মাধ্যমে জাপানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
যুদ্ধ আরম্ভ হয়। জাপানি সমরশক্তি
ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি জায়গায়
ছড়িয়ে পড়ে দুর্বল হয়ে
যায়, কিন্তু মার্কিন বিমান আক্রমণের মাধ্যমে জনসাধারণের অত্যধিক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সেনাবাহিনী অনমনীয় থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঞ্চুরিয়া অধিকার ও হিরোশিমা ও
নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমাবর্ষণের অব্যবহিত পরে ১৪ই আগস্ট
১৯৪৫ এ জাপান নিঃশর্ত
আত্মসমর্পণ করে।
১৯৫২
পর্যন্ত জাপান মিত্রশক্তির অধীনে থাকে। ১৯৪৭ এ মিত্রশক্তির
তত্ত্বাবধানে নতুন সংবিধান রচিত
হয়। এর মাধ্যমে জাপান
একটি সংসদীয় রাজতন্ত্রে পরিণত হয়। এই ব্যবস্থায়
সম্রাটের পাশাপাশি কোক্কাই নামে একটি নির্বাচিত
আইনসভাও গঠিত হয়।১৯৫৫ এর
পর জাপানের অর্থনীতি অত্যন্ত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায়। ১৯৯০ এর পর
থেকে এই পর্যায় সমাপ্ত
হয় এবং আর্থিক অচলাবস্থা
প্রশাসনের চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে।
২০১১ তে একটি বড়
ভূমিকম্প ও সুনামি এবং
ফুকুশিমা-দাইচি নিউক্লীয় দুর্ঘটনা ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে।
জাপানের
ভূগোল ও জলবায়ু
জাপান
একটি যৌগিক আগ্নেয়গিরীয় দ্বীপমালা। এই দ্বীপমালাটি ৬,৮৫২টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। জাপানের উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রধান
চারটি দ্বীপ হল হোনশু, হোক্কাইদো,
ক্যুশু ও শিকোকু। এই
চারটি দ্বীপ জাপানের মোট ভূখণ্ডের ৯৭%
এলাকা নিয়ে গঠিত। অধিকারভুক্ত দ্বীপগুলি সহ এই দেশটি
২৪° ও ৪৬° উত্তর
অক্ষাংশ এবং ২২° ও
১৪৬° পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। ওকিনাওয়া সহ র্যু ক্যু
দ্বীপপুঞ্জ হল ক্যুশুর দক্ষিণে
একটি দ্বীপমালা। এই সব দ্বীপগুলিকে
একসঙ্গে জাপান দ্বীপমালা বলা হয়ে থাকে।
জাপান
ভূখণ্ডের ৭৩ শতাংশই বনভূমি,
পার্বত্য অঞ্চল এবং কৃষি, শিল্প
বা গৃহনির্মাণের অনুপযোগী। এই কারণে জনবসতি
অঞ্চলগুলি, যেগুলি মূলত উপকূলীয় অঞ্চলে
অবস্থিত, সেগুলি অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ। জাপান
বিশ্বের সর্বাধিক জনঘনত্বপূর্ণ দেশগুলির অন্যতম।
জাপানের ভূ-সংস্থানিক মানচিত্র
জাপানের
দ্বীপগুলি প্রশান্ত মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলার আগ্নেয়গিরি অঞ্চলে অবস্থিত। এই দেশটি প্রশান্ত
মহাসাগরের বুকে জাপান সাগর,
পূর্ব চীন সাগর, চীন,
উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও রাশিয়ার পূর্ব
দিকে উত্তরে ওখোৎস্ক সাগর থেকে দক্ষিণ
পূর্ব চীন সাগর ও
তাইওয়ান পর্যন্ত প্রসারিত। দক্ষিণে মহাদেশীয় আমুরিয়ান পাত ও ওকিনাওয়া
পাতের তলায় ফিলিপিন সাগর পাতের অবনমন
এবং উত্তরে ওখোটস্ক পাতের তলায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাতের অবনমনের ফলে কয়েক কোটি
বছর ধরে মধ্য-সিলুরিয়ান
থেকে প্লেইস্টোসিন যুগে সংঘটিত একটি
প্রকাণ্ড মহাসাগরীয় চলন এর কারণ।
জাপান প্রকৃতপক্ষে ইউরেশীয় মহাদেশের পূর্ব উপকূলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। নিমজ্জমান পাতগুলি
জাপানকে পূর্ব দিকে টেনে আনে।
এর ফলে ১৫ মিলিয়ন
বছর আগে জাপান সাগরের
উদ্ভব ঘটে।
জাপানে
১০৮টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে। ২০শ শতাব্দীতে
আরও কয়েকটি নতুন আগ্নেয়গিরির উদ্ভব
হয়। এর মধ্যে হোক্কাইডোয়
শোওয়া-শিনজান ও প্রশান্ত মহাসাগরের
বেয়ননাইস রকসের কাছে ম্যোজিন-শো
উল্লেখযোগ্য। এই দেশে প্রতি
শতাব্দীতেই বিধ্বংসী ভূমিকম্প এবং তার ফলে
সুনামি ঘটে থাকে। ১৯২৩
সালের টোকিয়োর ভূমিকম্পে ১৪০,০০০ জনের
প্রাণহানি ঘটেছিল। সাম্প্রতিক কালের ভূমিকম্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৯৯৫ সালের গ্রেট
হানশিন ভূমিকম্প ও ২০১১ সালের
১১ মার্চ ৯.০ মাত্রার
তোওহোকু ভূমিকম্প। শেষোক্ত ভূমিকম্পটির ফলে একটি প্রকাণ্ড
সুনামি জাপানে আছড়ে পড়ে।
প্রশান্ত
মহাসাগরীয় আগ্নেয় মেখলায় অবস্থিত হওয়ার দরুন জাপানে প্রায়শই
ভূমিকম্প ও সুনামির ঘটনা
ঘটে। উন্নত বিশ্বের মধ্যে জাপানই সর্বোচ্চ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিপদসঙ্কুল দেশ।
জাপানের
জলবায়ু প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ প্রকৃতির। তবে উত্তর থেকে
দক্ষিণে জলবায়ুর মধ্যে বিরাট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। জাপানের ভৌগোলিক
বৈশিষ্ট্যগুলি ছয়টি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলের মধ্যে বিভাজিত হয়েছে। এগুলি হল: হোক্কাইডো, জাপান
সাগর, কেন্দ্রীয় উচ্চভূমি, সেতো অন্তর্দেশীয় সাগর,
প্রশান্ত মহাসাগর ও র্যু ক্যু
দ্বীপপুঞ্জ। সর্ব উত্তরে অবস্থিত
অঞ্চল হোক্কাইডোতে আর্দ্র মহাদেশীয় জলবায়ু দেখা যায়। এখানে
শীতকাল দীর্ঘ ও শীতল এবং
গ্রীষ্মকাল খুব উষ্ণ থেকে
শীতল। এখানে ভারি বৃষ্টিপাত দেখা
যায় না। তবে শীতকালে
দ্বীপগুলি শীতকালে গভীর তুষারের চাদরে
আচ্ছাদিত হয়ে যায়।
মাউন্ট ফুজি - ঘুমন্ত আগ্নেওগিরি
জাপান
সাগর অঞ্চলটি হোনশুর পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত। এখানে উত্তরপশ্চিম শীতকালীন বায়ুর প্রভাবে ভারি তুষারপাত ঘটে।
গ্রীষ্মকালে এই অঞ্চলটি প্রশান্ত
মহাসাগরীয় এলাকার তুলনায় শীতলতর থাকে। যদিও কখনও কখনও
ফন বায়ুর প্রভাবে এই অঞ্চলটি অত্যধিক
উষ্ণ হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয়
উচ্চভূমি অঞ্চলে অন্তর্দেশীয় আর্দ্র মহাদেশীয় জলবায়ু লক্ষিত হয়। এখানে গ্রীষ্মে
ও শীতে এবং দিনে
ও রাতে তাপমাত্রার বিরাট
পার্থক্য দেখা যায়। এই
অঞ্চলে হালকা বৃষ্টিপাত হয়। যদিও শীতকালে
সাধারণত তুষারপাত ঘটে। চুউগোকু ও
শিকোকু অঞ্চলের পার্বত্য এলাকা সেতো অন্তর্দেশীয় সাগর
অঞ্চলকে মৌসুমি বায়ুর হাত থেকে রক্ষা
করে। ফলে এই অঞ্চলে
সারা বছরই আবহাওয়া মনোরম
থাকে।
প্রশান্ত
মহাসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে আর্দ্র উপক্রান্তীয় জলবায়ু দেখা যায়। এখানে
শীতকাল তীব্র নয়। মাঝে মাঝে
এখানে তুষারপাত হয়। অন্যদিকে দক্ষিণপূর্ব
মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও আর্দ্র।
র্যু ক্যু দ্বীপপুঞ্জের জলবায়ু
উপক্রান্তীয় প্রকৃতির। এখানে শীতকাল উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকাল
তীব্র উষ্ণ। এই অঞ্চলে প্রধানত
বর্ষাকালে অত্যন্ত ভারি বৃষ্টিপাত হয়।
জাপানের
গড় শীতকালীন তাপমাত্রা ৫.১ °সে
(৪১.২ °ফা) এবং
গড় গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা ২৫.২ °সে
(৭৭.৪ °ফা)।
জাপানের সর্বকালীন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা—৪০.৯ °সে
(১০৫.৬ °ফা)—নথিভুক্ত
হয়েছিল ২০০৭ সালের ১৬
অগস্ট। ওকিনাওয়ায় প্রধান বর্ষা ঋতু শুরু হয়
মে মাসের গোড়ার দিকে। বৃষ্টি রেখা ধীরে ধীরে
উত্তর দিকে সরতে সরতে
জুলাই মাসের শেষ দিকে হোক্কাইডোয়
এসে উপস্থিত হয়। হোনশুর অধিকাংশ
অঞ্চলে বর্ষাকাল শুরু হয় জুন
মাসের মাঝামাঝি সময় এবং স্থায়ী
হয় ছয় সপ্তাহের জন্য।
গ্রীষ্মকালের শেষ দিকে এবং
শরৎকালের গোড়ার দিকে টাইফুন ঝড়
ভারি প্রায়শই ভারি বৃষ্টিপাত ঘটায়।
ধর্ম
জাপানের
প্রধান দুইটি ধর্ম হলো শিন্তো
ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্ম।
প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের প্রাচীন উপাসনার বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী শিন্তো ধর্মের ভিত্তি। শিন্তো ধর্মে মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে কিছু
বলা নেই বলে বৌদ্ধ
ধর্ম ও শিন্তো ধর্ম
বহু যুগ ধরে জাপানে
সহাবস্থান করেছে। অনেক ক্ষেত্রে শিন্তো
উপাসনালয় এবং বৌদ্ধ মন্দিরগুলি
প্রশাসনিকভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানেও
বহু জাপানি দুই ধর্মই সমানভাবে
অনুসরণ করে। শিন্তো ধর্ম
১৬শ থেকে ১৯শ শতকে
বিস্তার লাভ করে।
মেইজি
পুনঃপ্রতিষ্ঠার সময় জাপানি নেতারা
শিন্তো ধর্ম গ্রহণ করেন
এবং এটিকে সরকারীভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে জাপানিদের মধ্যে
জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমী অনুভূতি
জাগিয়ে তুলতে ব্যবহার করেন। জাপানের সম্রাটকে ইশ্বরের অবতার মনে করা হত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিন্তো ধর্মের
জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষোকতা বন্ধ হয়ে যায়
এবং সম্রাট দেবত্ব বিসর্জন দেন। বর্তমান জাপানিদের
জীবনে শিন্তো ধর্মের কোন কেন্দ্রীয় ভূমিকা
নেই। স্বল্প সংখ্যক অনুসারী বিভিন্ন শিন্তো উপাসনালয়গুলিতে যান। ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত
বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় উপাসনালয়গুলিতে অনেক পর্যটকেরাও বেড়াতে
আসেন। এগুলিতে বহু বিবাহ অনুষ্ঠান
সম্পন্ন হয় এবং জন্মের
পর ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ
সময়ে শিশুদের এখানে নিয়ে আসা হয়। প্রতি
বছর এগুলিকে কেন্দ্র করে অনেক উৎসব
হয়। জাপানের অনেক বাসাতে শিন্তো
দেবদেবীদের পূজার উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি তাক বা
স্থান থাকে।
ইতসুকুশিমা
৬ষ্ঠ
শতকে জাপানে প্রথম বৌদ্ধ ধর্মের প্রচলন হয় এবং এর
পরের প্রায় ১০ শতক ধরে
এটি জাপানের বুদ্ধিবৃত্তিক, শৈল্পিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের
উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
জাপানের বেশির ভাগ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দায়িত্বে থাকেন
বৌদ্ধ পুরোহিতেরা। বহু জাপানি পূর্বপুরুষদের
স্মরণে বৌদ্ধ মন্দিরে যায়।
৬ষ্ঠ
ও ৯ম শতকের মাঝামাঝি
সময়ে চীন থেকে কনফুসিয়াসবাদের
আগমন ঘটে। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের
তুলনায় এর গুরুত্ব ছিল
কম। ১৯শ শতকের শেষভাগ
পর্যন্ত এটি জাপানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে
বিরাজমান ছিল এবং আজও
জাপানি চিন্তাধারা ও মূল্যবোধে কনফুসিয়াসের
দর্শনের বড় প্রভাব দেখতে
পাওয়া যায়।
১৫৪৯
সালে জাপানে খ্রিস্টধর্মের আগমন ঘটে এবং
এক শতাব্দী পরে এটিকে সরকার
নিষিদ্ধ করে দেন। পরে
১৯শ শতকের শেষভাগে এসে এটি আবার
জাপানে উপস্থাপিত হয় এবং খুব
ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে।
বর্তমানে জাপানে প্রায় ৩০ লক্ষ খ্রিস্টান
বাস করে।
বর্তমানে
অনেক জাপানি বেশ কিছু নতুন
নতুন ধর্মের বা বিশ্বাস ব্যবস্থার
অনুসারী হওয়া শুরু করেছে, যেগুলি
শিন্তো, বৌদ্ধধর্ম,থেকে ধারণা ধার
নিয়েছে এবং স্থানীয় জনগণের
সামাজিক চাহিদা মেটাতে গড়ে উঠেছে। এরকম
নতুন ধর্মের সংখ্যা কয়েকশ'র মত। এগুলি
সব মিলিয়ে কোটি কোটি জাপানি
অনুসরণ করে থাকে।
সরকার
ব্যবস্থা এবং রাজনীতি
জাপান
একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। এখানে সম্রাটের ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবিধান তাকে "রাষ্ট্র ও জনগণের ঐক্যের
প্রতীক" হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রকৃত ক্ষমতা প্রধানত প্রধানমন্ত্রী ও ডায়েটের অন্যান্য
নির্বাচিত সদস্যদের হাতে ন্যস্ত থাকে।
দেশের সার্বভৌমত্ব জাপানি জাতির হাতে ন্যস্ত। জাপানের
বর্তমান সম্রাট হলেন নারুহিতো। যুবরাজ
ফুমিহিতো তার পরে চ্র্যিসানথেমাম
সিংহাসনের দাবিদার।
জাপানের
আইনবিভাগ হল ন্যাশনাল ডায়েট।
এটি টোকিওর চিয়োদায় অবস্থিত। ডায়েট একটি দ্বিকক্ষীয় আইনসভা।
হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস কক্ষটি
৪৮০ সদস্যবিশিষ্ট। এই কক্ষের সদস্যরা
জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন।
এই কক্ষের মেয়াদ চার বছর বা
ভেঙে না দেওয়া পর্যন্ত।
অপর কক্ষ হাউস অফ
কাউন্সিলরসের সদস্য সংখ্যা ২৪২। এই কক্ষের
সদস্যরা জনগণের ভোটে ছয় বছরের
জন্য নির্বাচিত হন। দেশের ২০
বছর বা তার বেশি
বয়স্ক নাগরিকদের সার্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃত। সকল নির্বাচন গোপন
ব্যালটে হয়। সামাজিক উদারনৈতিক
ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ জাপান ও
রক্ষণশীল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) ডায়েটের প্রধান দুই দল। ১৯৫৫
সাল থেকে এলডিপি নিরবিচ্ছিন্ন
নির্বাচনী সাফল্য অর্জন করে আসছে (১৯৯৩
থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত
১১ মাস এবং ২০০৯
থেকে ২০১২ সাল ব্যতিরেকে)। নিম্নকক্ষে এই
দলের সদস্য সংখ্যা ২৯৪ এবং উচ্চ
কক্ষে এর সদস্য সংখ্যা
৮৩।
জাপানের
প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকার প্রধান।
সদস্যদের মধ্যে থেকে ডায়েট কর্তৃক
মনোনীত হওয়ার পর তাকে সম্রাট
প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রীই ক্যাবিনেটের প্রধান। তিনি রাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিযুক্ত বা
পদচ্যুত করতে পারেন। ২০১২
সালের সাধারণ নির্বাচনে এলডিপির বিপুল জয়ের পর ওই বছর
২৬ ডিসেম্বর ইয়োশিহিকো নোদাকে অপসৃত করে শিনযো আবে
প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি দেশের
৬ষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ছয় বছরের জন্য
শপথ নেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে
সম্রাট নিযুক্ত করলেও দেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, যাঁকে
ডায়েট মনোনীত করবে, সম্রাট কেবল তাকেই প্রধানমন্ত্রী
হিসেবে নির্বাচিত করতে পারবেন।
অতীতে
চীনা আইন দ্বারা প্রভাবিত
হলেও এদো যুগে কুজিকাতা
ওসাদামেগাকি প্রভৃতি গ্রন্থের মাধ্যমে জাপানি আইন ব্যবস্থা স্বতন্ত্রভাবে
বিকশিত হয়ে ওঠে। যদিও
১৯শ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে জাপানের বিচার
ব্যবস্থা ইউরোপের (প্রধানত জার্মানির) ফৌজদারি আইনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। উদাহরণ
স্বরূপ, ১৮৯৬ সালে জাপান
সরকার জার্মান বুরগারলিকস গেসেজবাচ-এর ভিত্তিতে ফৌজদারি
বিধি প্রবর্তন করেন, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর
সংস্কার পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। সাংবিধানিক আইনের
উৎস আইনসভা। এই আইনে সম্রাটের
রাবার স্ট্যাম্প থাকে। সাংবিধানিক বিধি অনুসারে, ডায়েটে
পাস হওয়া আইনকে সম্রাটের অনুমোদন পেতেই হবে। তবে পাস
হওয়া আইনের বিরোধিতা করার ক্ষমতা সম্রাটকে
দেওয়া হয়নি। জাপানের বিচার ব্যবস্থার চারটি মৌলিক স্তরে বিভক্ত: সুপ্রিম কোর্ট ও তিন স্তরের
নিম্নবর্তী আদালত। জাপানের সাংবিধানিক আইনের মূল অংশটিকে বলা
হয় সিক্স কোডস।
অর্থনীতি
জাপান
একটি শিল্পোন্নত দেশ যার বাজারভিত্তিক
অর্থনীতি বিশ্বের ২য় বৃহত্তম অর্থনীতি।
এর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক
খাতগুলি অত্যন্ত দক্ষ ও প্রতিযোগিতাশীল।
তবে সুরক্ষিত খাত যেমন কৃষি,
বিতরণ এবং বিভিন্ন পরিষেবায়
উৎপাদনশীলতা তুলনামূলকভাবে কম। আধুনিক জাপানের
অর্থনৈতিক বিকাশ শুরু হয়েছিল এদো
যুগে। এদো যুগের অধুনা
বিদ্যলাম শিল্প উপাদানগুলির মধ্যে সড়ক ও জলপথ
এবং ফিউচার্স কনট্র্যাক্টস, ব্যাংকিং ও ওসাকা রাইস
ব্রোকারসের বিমাগুলির মতো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি
উল্লেখযোগ্য। ১৮৬৮ সাল থেকে
মেইজি যুগে জাপানের অর্থনীতি
প্রসার লাভ করে। এই
সময় জাপান বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করেছিল। আজকের অনেক সংস্থা সেই
যুগে স্থাপিত হয়েছিল। সেই সময় থেকেই
জাপান এশিয়ার সর্বাধিক সর্মৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে
উঠতে শুরু করে। ১৯৬০
থেকে ১৯৮০-এর দশক
পর্যন্ত জাপানের সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশকে বলে হয় জাপানের
যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক বিস্ময়। এই বৃদ্ধির হার
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর
দশকে ছিল ৭.৫
এবং ১৯৮০-এর দশক
ও ১৯৯০-এর দশকের
গোড়ার দিকে ছিল ৩.২। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে এসে
"বুদ্বুদ অর্থনীতিতে" ধ্বস নামলে জাপানের
অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নাটকীয়ভাবে ধীর হয়ে পড়ে।
স্টক এবং রিয়েল এস্টেটের
দাম অনেক পড়ে যায়।
১৯৯০-এর দশকে জাপানিজ
অ্যাসেট প্রাইস বাবল ও শেয়ার
বাজার ও রিয়েল এস্টেট
বাজার থেকে স্পেকুলেটিক এক্সেস
আরোপ করার সরকারি নীতি
ফলস্রুতিতে যে "লস্ট ডিকেডে"র
ঘটনা ঘটে, তার ফলে
আর্থিক বৃদ্ধি কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। বৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রচেষ্টা
ব্যর্থ হয় এবং ২০০০
সালের বিশ্বজনীন মন্দার প্রেক্ষিতে তা আরও হ্রাস
পায়। ২০০৫ সালের পর
অর্থনৈতিক বৃদ্ধি আবার শুরু হয়।
সেই বছরের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ২.৮%, যা সেই
বছরের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ের
বৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে যায়।
২০১২
সালের হিসেব অনুসারে, নামমাত্র জিডিপি অনুসারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পর
জাপানই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জাতীয় অর্থনীতি এবং ক্রয়ক্ষমতা সাম্যের
হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের
পর চতুর্থ বৃহত্তম জাতীয় অর্থনীতি। ২০১৩ সালের হিসেব
অনুসারে, জাপানের সরকারি ঋণের পরিমাণ দেশের
বার্ষিক মোট আভ্যন্তরিণ উৎপাদনের
২০০ শতাংশেরও বেশি বলে অনুমান
করা হয়েছে, যা বিশ্বের দেশগুলির
মধ্যে বৃহত্তম। ২০১১ সালে মুডি’জ রেটিং জাপানের
দীর্ঘমেয়াদি সার্বভৌম ঋণ রেটিং এক
নচকে এএ৩ থেকে কমিয়ে
এএ২ করেছে দেশের ঘাটতি ও ধার করার
মাত্রা অনুসারে। ২০০৯ সালে বিশ্বজনীন
মন্দা এবং ২০১১ সালের
মার্চে ভূমিকম্প ও সুনামির ফলে
যে বিশাল বাজেট ঘাটতি ও সরকারি ঋণ
বৃদ্ধি পায় তা রেটিং-এর হারকে কমিয়ে
দেয়।
শিল্পনেতা,
কারিগর, সুশিক্ষিত ও পরিশ্রমী কর্মী
বাহিনী, উচ্চ মাত্রায় সঞ্চয়ের
প্রবণতা, উচ্চ বিনিয়োগ হার,
শিল্প ও বৈদেশিক বাণিজ্য
উন্নয়নের জন্য সরকারের জোরালো
সমর্থন --- এ সব কিছু
মিলে জাপান একতি পরিণত শিল্পোন্নত
অর্থনীতি। জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ খুব কম। কিন্তু
বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে জাপান যে বৈদেশিক মুদ্রা
আয় করে, তা অর্থনীতির
জন্য কাঁচামাল ক্রয়ে ব্যবহার করা হয়।
জাপানের
অর্থনীতি ভবিষ্যতে ভাল থাকার সম্ভাবনা
আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৯০-এর
দশকে এসে প্রথমবারের মত
জাপান অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্থবির একটি পর্যায়ে প্রবেশ
করে, যে সময় প্রবৃদ্ধির
হার ছিল বছরে গড়ে
মাত্র ১%। ২০০০
সালের পর থেকে এর
কিছুটা উন্নতি হওয়া শুরু হয়েছে। ২০০৭
সালে প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২%-এর কিছু বেশি।
জাপানের
মাত্র ১৫% ভূমি আবাদযোগ্য।
কৃষিখাত সরকার থেকে প্রচুর ভর্তুকি
পায়। প্রতি হেক্টর জমিতে জাপানের কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ
বিশ্বের সর্বোচ্চগুলির একটি। জাপান তার নিজের কৃষিজমি
ব্যবহার করে কৃষিতে প্রায়
৪০% স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে ধানের
উৎপাদন দেশের চাহিদা মিটিয়ে খানিকটা উদ্বৃত্ত থেকে যায়। কিন্তু
গম, ভুট্টা, সয়াবিন ইত্যাদি বিপুল পরিমাণে বিদেশ থেকে আমদানি করতে
হয়। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
থেকেই এগুলি আসে। জাপান তাই
মার্কিন কৃষি রপ্তানির প্রধানতম
বাজার।
জ্বালানিশক্তির
জন্য জাপান বিদেশের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু
১৯৭০-এর তেল সংকটের
পর থেকে জাপান পেট্রোলিয়ামের
পরিবর্তে শক্তির অন্য উৎস ব্যবহারের
পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে জাপানের মাত্র অর্ধেক শক্তি পেট্রোলিয়ামজাত তেল থেকে আসে।
অন্য জ্বালানির মধ্যে আছে কয়লা, তরলীকৃত
প্রাকৃতিক গ্যাস, নিউক্লীয় শক্তি এবং জলবিদ্যুৎ। বর্তমানে
জাপান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তি-সাশ্রয়ী উন্নত অর্থনীতিগুলির একটি।
জাপানে
সোনা, ম্যাগনেসিয়াম ও রূপার মজুদ
ভাণ্ডার দেশের বর্তমান শিল্প চাহিদা মেটাতে সক্ষম। কিন্তু জাপান আধুনিক শিল্পে ব্যবহৃত অনেক খনিজের জন্য
বিদেশের উপর নির্ভরশীল। লোহার
আকরিক, কোক কয়লা, তামা,
বক্সাইট এবং বহু বনজ
দ্রব্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে
হয়।
জাপানের
শ্রমিকসংখ্যা প্রায় ৬ কোটি ৭০
লক্ষ। এদের মধ্যে ৪০%-ই নারী। প্রায়
১ কোটি শ্রমিক কোন
না কোন শ্রমিক সঙ্ঘের
সাথে জড়িত।
আমদানি
জাপানের
প্রধান আমদানি দ্রব্যগুলি হল যন্ত্রপাতি, ফসিল
জ্বালানি, খাদ্যদ্রব্য (প্রধানত গোমাংস), রাসায়নিক দ্রব্য, বস্ত্র ও জাপানের শিল্পগুলির
কাঁচামাল। বাজার শেয়ার পরিমাপ অনুযায়ী, ওইসিডি দেশগুলির মধ্যে জাপানের আভ্যন্তরিণ বাজারই সর্বাপেক্ষা কম উন্মুক্ত। জুনিচিরো
কোইজুমির প্রশাসন কিছু প্রতিযোগিতামুখী সংস্কার
সাধন করেছিল এবং সেই সময়
জাপানে বিদেশি বিনিয়োগ শুরু হয়েছিল।
২০১৪
ইস অফ ডুইং বিজনেস
ইনডেক্স অনুসারে, ১৮৯টি দেশের মধ্যে জাপানের স্থান ২৭তম। এই দেশ উন্নত
বিশ্বের ক্ষুদ্রতম আয়কর দাতা দেশগুলির একটি।
জাপানের ধনতন্ত্রের অনেকগুলি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে: কেইরেৎসু সংস্থাগুলি প্রভাবশালী, জাপানের কার্য পরিবেশে স্থায়ী নিয়োগ ও অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক
কর্মজীবনের প্রাধান্য গুরুত্ব পায়। জাপানি কোম্পানিগুলি
"টোয়োটা ওয়ে" নামে পরিচিত ব্যবস্থাপন
পদ্ধতির জন্য পরিচিত। এখানে
শেয়ারহোল্ডার কার্যকারিতা খুব কমই দেখা
যায়।
জাপানের
কয়েকটি বড়ো সংস্থা হল
টয়োটা, নিন্টেন্ডো, এনটিটি ডোকোমো, ক্যানন, হোন্ডা, টাকেডা ফার্মাকিউটিক্যাল, সনি, নিপ্পন ওয়েল
ও সেভেন অ্যান্ড আই হোল্ডিংস কোম্পানি।
বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম ব্যাংক জাপানে অবস্থিত। টোকিও শেয়ার বাজার (নিক্কেই ২২৫ ও টিওপিআইএক্স
ইন্ডিসেসের জন্য পরিচিত) মার্কেট
ক্যাপিটালাইজেশন অনুসারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শেয়ার বাজার। ২০০৬ সালের হিসেব
অনুসারে, জাপান ফোর্বস গ্লোবাল ২০০০ থেকে ৩২৬টি
কোম্পানির দেশ, যার শতাংশ
হার ১৬.৩। ২০১৩
সালে ঘোষণা করা হয়, জাপান
শেল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করবে।
রপ্তানি
জাপানের
শিল্পক্ষমতা বৃহৎ। এই দেশ বিশ্বের
বৃহত্তম ও প্রযুক্তিগত দিক
থেকে অগ্রণী মোটরগাড়ি, ইলেকট্রনিকস, যন্ত্রাংশ, ইস্পাত ও অলৌহঘটিত ধাতু,
জাহাক, রাসায়নিক দ্রব্য, বস্ত্র, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প কেন্দ্রগুলির অন্যতম। জাপানে কৃষি ব্যবসা দেশের
জমির ১৩% ব্যবহার করে।
এদেশের মৎস্যচাষ সারা বিশ্বের মৎস্যচাষের
প্রায় ১৫শ, যা চীনের
পরে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী। ২০১০ সালের হিসেব
অনুসারে, জাপানে শ্রমিক সংখ্যা ৬৫.৯ মিলিয়ন।
জাপানে বেকারত্বের হার বেশ কম
– প্রায় ৪%। ২০০৭
সালের হিসেব অনুযায়ী, জাপানে প্রায় ২০ মিলিয়ন লোক
(জনসংখ্যার প্রায় ১৭%) দারিদ্র্যসীমার নিচে
বসবাস করে। শহরাঞ্চলে স্থানাভাব
জাপানে গৃহনির্মাণ শিল্পে প্রভাব ফেলেছে।
২০০৫
সালের হিসেব অনুযায়ী, জাপানের মাথাপিছু রফতানির আয় ৪,২১০
মার্কিন ডলার। ২০১২ সালের হিসেব
অনুসারে, জাপানের রফতানি বাজারগুলি হল চীন (১৮.১%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
(১৭.৮%), দক্ষিণ কোরিয়া
(৭.৭%), থাইল্যান্ড (৫.৫%) ও হংকং
(৫.১%)। জাপান
প্রধানত পরিবহন যন্ত্রাংশ, মোটরগাড়ি, লৌহ ও ইস্পাত
সামগ্রী, সেমিকনডাক্টর ও গাড়ি যন্ত্রাংশ
রফতানি করে। ২০১২ সালের
হিসেব অনুযায়ী, জাপানের প্রধান আমদানি বাজার হল চীন (২১.৩%), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
(৮.৮%), অস্ট্রেলিয়া (৬.৪%), সৌদি আরব
(৬.২%), সংযুক্ত আরব
আমিরশাহি (৫%), দক্ষিণ কোরিয়া
(৪.৬%) ও কাতার
(৪%)।
বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তিতে জাপান
বৈজ্ঞানিক
গবেষণা, বিশেষত প্রযুক্তি, যন্ত্রবিদ্যা ও বায়োমেডিক্যাল গবেষণায়
জাপান একটি অগ্রণী রাষ্ট্র।
প্রায় ৭০০,০০০ গবেষক
১৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার গবেষণা ও
উন্নয়ন বাজেটের সুবিধা পান এই দেশে।
এই বাজেট বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাতেও জাপান বিশ্বে অগ্রণী একটি রাষ্ট্র। এই
দেশ থেকে একুশ জন
বৈজ্ঞানিক পদার্থবিদ্যা, রসায়ন বা চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল
পুরস্কার পেয়েছেন। তিন জন ফিল্ডস
মেডেল এবং একজন কার্ল
ফ্রেডরিক গাস প্রাইজ পেয়েছেন।
জাপানের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত অবদানগুলি ইলেকট্রনিকস, অটোমোবাইলস, যন্ত্রবিদ্যা, ভূমিকম্প ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবোট, অপটিকস, কেমিক্যালস, সেমিকন্ডাক্টরস ও ধাতুবিদ্যার ক্ষেত্রে
রয়েছে। বিশ্বে রোবোটিকস উৎপাদন ও ব্যবহারে জাপান
অগ্রণী। ২০১৩ সালের হিসেব
অনুসারে, বিশ্বের শিল্প রোবোটগুলির ২০% (১.৩
মিলিয়নের মধ্যে ৩০০,০০০টি) জাপানে
নির্মিত। যদিও আগে এই
হার আরও বেশি ছিল।
২০০০ সালে সারা বিশ্বে
শিল্প রোবোটগুলির অর্ধ্বাংশ ছিল জাপানে নির্মিত।
জাপানিজ এক্সপেরিমেন্ট মডিউল
জাপানের
মহাকাশ সংস্থা হল জাপান এয়ারোস্পেস
এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (জাক্সা)। এখান থেকে
মহাকাশ, ভিন্ন গ্রহ ও বিমান
গবেষণার কাজ চলে। রকেট
ও উপগ্রহ নির্মাণেও এটি অগ্রণী সংস্থা।
জাপান আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে অংশগ্রহণকারী। ২০০৮ সালে স্পেস
শাটল অ্যাসেম্বলি ফ্লাইটের সময় সেখানে জাপানিজ
এক্সপেরিমেন্ট মডিউল যুক্ত হয়। জাপানের মহাকাশ
অভিযানের পরিকল্পনাগুলি হল: শুক্র গ্রহে
আকাৎসুকি নামে একটি মহাকাশ
যান পাঠানো; ২০১৬ সালে মারকুরি
ম্যাগনেটোস্ফেরিক অরবিটার উৎক্ষেপণ; এবং ২০৩০ সালের
মধ্যে চাঁদে একটি বেস গঠন।
২০০৭
সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাপান
"সেলিনে" (সেলেনোলোজিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপ্লোরার) নামে একটি চন্দ্রযান
একটি এইচ-আইআইএ (মডেল
এইচ২এ২০২২) ক্যারিয়ার রকেটের মাধ্যমে তানেগাশিমা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণ করে।
অ্যাপোলো কর্মসূচির পর থেকে বৃহত্তম
চন্দ্র অভিযান ছিল কাগুয়া। এর
উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের উৎস
ও বিবর্তন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ। ৪
অক্টোবর এটি চাঁদের কক্ষপথে
প্রবেশ করে এবং প্রায়
১০০ কিমি (৬২ মা) উচ্চতায়
উড়ে যায়। এই যানটির অভিযান
শেষ হয় ২০০৯ সালের
১১ জুন। এই দিন
জাক্সা ইচ্ছাকৃতভাবে চাঁদের সঙ্গে এই যানটির সংঘর্ষ
ঘটিয়েছিল।
বিচিত্র
কিছু তথ্য -
- জাপানি ভাষায় ‘জাপান’ শব্দের অর্থ নিপ্পন, যার অর্থ ‘উদীয়মান সূর্যের ভূমি'। অর্থাৎ জাপান হলো সেই দেশ যে দেশের জনগণ ভোরে প্রথম সূর্য দেখে থাকে।
- •জাপানে শিশুদের স্কুলে পড়ালেখার পাশাপাশি আদব-কায়দা শেখানোর বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখা হয়ে থাকে। প্রতিদিন ১৫ মিনিট স্কুলে ছাত্র-শিক্ষক নিজেরাই মিলেমিশে একসাথে ক্লাসরুম, ক্যাফেটেরিয়া ইত্যাদি পরিষ্কার করেন, কোন কাজকেই ছোট করে না দেখার অভ্যাস এখান থেকেই গড়ে ওঠে জাপানী শিশুদের।
- চেরি ফুল (শাকুরা) জাপানের জাতীয় ফুল।
- জাপানে আবার্জনা ক্লিনারদের হেলথ ইঞ্জিনিয়ার বলা হয়, যাদের মাসিক বেতন প্রায় ৫০০০-৮০০০ ডলার।
- জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মাত্র ১০ বছরের মাথায় তা পুনরায় তার আগের জায়গায় ফিরে আসে। তবে জাপানের সেই হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আগের মতো আর ফসল ফলে না। এখনও সেখানে বিকলাঙ্গ শিশু জন্মগ্রহণ করে!
- বিশ্বের একটি ধনী দেশ হয়েও জাপানিরা কাজের মানুষ রাখে না। সবকাজ পরিবারের সবাই ভাগ করে মিলেমিশে সম্পন্ন করে থাকে। সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মানুষের তালিকায় জাপানের অবস্থান তৃতীয়। গড়ে প্রায় ৮৩ বছর বাঁচে জাপানীরা, পুরো জীবনটাই কাটে কাজের প্রতি বিপুল উদ্দীপনায়, পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যাণে।
- জাপানিদের আত্মসম্মানবোধ প্রচন্ড তীব্র। সম্মানের খাতিরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার অজস্র নজির রয়েছে দেশটিতে। জাপানের বেশ কয়জন প্রধানমন্ত্রী অল্প কয়টি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন, কথা দিয়ে সে কথা রক্ষার ব্যাপারে তারা অত্যন্ত কঠোর। টাইটানিক জাহাজডুবি থেকে যে কয়জন জাপানি বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছিলেন, দেশে ফিরে তাদের প্রবল জনরোষের সম্মুখীন হতে হয়। “সহযাত্রীদের বাঁচাতে যদি নাই পারলে, তবে তাদের সাথেই প্রাণ কেন দিলে না!” এই ছিলো জনতার আক্ষেপ!
- জাপান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে কাজে এক মিনিট দেরি করে আসাকেও বিরাট অপরাধ হিসেবে দেখা হয়! সবকিছু অসম্ভব নিখুঁতভাবে সময় মেনে চলে, এতটাই নিখুঁত যে পাবলিক ট্রেনগুলোর গড়ে ১৮ সেকেন্ডের বেশি দেরি করার কোন নজির নেই। এবং দেরিগুলোও হয় বিচিত্র সব কারণে, সবচেয়ে বড় কারণ ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা! প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের একটি অন্ধকার দিক আছে, পারিবারিক বন্ধনগুলো দুর্বল করে দিচ্ছে এই প্রযুক্তির আতিশয্য। একটা অসুস্থ আসক্তির বুদবুদের ভেতর আটকা পড়ে থাকে হাজার হাজার মানুষ, ব্যক্তিগত জীবনে অসম্ভব নিঃসঙ্গ এই মানুষগুলো বিচিত্র সব উপায়ে নিঃশেষ করে দেয় তাদের জীবন ঝাঁকে ঝাঁকে প্রতিদিন।
- জাপানে রেস্টুরেন্টে ও ট্রেনে মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ।
- জর্জ লুকাসের বিখ্যাত চলচ্চিত্র স্টার ওয়ারের মূল ভিত্তি ছিলো, জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া দ্বারা পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘দ্য লুকড ফোর্ট্টা’।
- জাপানি ভাষায় “ওভারটাইম” শব্দটি নেই তবে এরচেয়ে গুরুতর একটি শব্দ আছে- “কারোশী” যার অর্থ “অতিরিক্ত কাজের চাপে মৃত্যু!’’ ব্যাপারটি শুনতে আজব মনে হলেও জাপানের প্রেক্ষাপটে এটি খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। সেখানে প্রতিবছর গড়ে ১০,০০০ মানুষ মারা যায় শুধুমাত্র অতিরিক্ত কাজের চাপে, ডায়াগনোসিসে তাদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা হয়- “কারোশী”!
- এটি ঠেকাতে অবশ্য জাপানিদের অভিনব একটি পন্থা রয়েছে। পৃথিবীর আর যে কোন দেশে অফিসে ঘুমালে মানুষ বসের ঝাড়ি খায়, এমনকি চাকরিও চলে যেতে পারে, কিন্তু একমাত্র জাপানে এই ব্যাপারটিকে উৎসাহিত করা হয়! কেননা সেখানে কাজ ফাঁকি দিয়ে ঘুমাবে এমন মানুষ বলতে গেলে নেই, বরং স্বেচ্ছায় ভয়াবহ খাটুনি করতে গিয়ে মারা পড়ার ঝুঁকি ঢের বেশি, তাই কাজের ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটি বলতে গেলে অলিখিত একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে দেশে!
- জাপানে সামাজিক বন্ধনগুলো খুব দৃঢ়। বিভিন্ন সমস্যায় সবাই মিলে একত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাধানে। জাপানের প্রতিটি মোবাইল ফোনে একটি ইমার্জেন্সি এলার্ট স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্ত করা থাকে। যে কোন দুর্যোগ বিপর্যয়ে এই এলার্মগুলো বেজে ওঠে সবার মোবাইলে (সাউন্ড অফ করা থাকলেও!) এবং মুহূর্তের মাঝে চলে যায় মেসেজ- এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে তাদের সেটি জানিয়ে। একবার একটি মজার ঘটনা ঘটেছে। সুনামি আর ভূমিকম্পের আঘাতে বিপর্যস্ত পুরো জাপান, আক্রান্ত জনপদের কাছে খাদ্য, চিকিৎসা, সেবা ইত্যাদি পৌঁছে দিতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার, এমন সময় জনগণের সেবায় মাঠে নেমে এলো কুখ্যাত জাপানি মাফিয়া গোষ্ঠী- ইয়াকুজা!
- জাপানিদের সংঘবদ্ধতা এবং পেশাদারিতা পুলিশের চেয়ে ঢের বেশি, দেখা গেল দুর্গম সব লোকালয়ে সরকারি সাহায্য পৌঁছানোর অনেক আগেই পৌঁছে গেছে তাদের ত্রাণ! এভাবেই দুর্যোগ আর বিপর্যয়ে গোটা জাতি যখন দুরবস্থায় পড়ে, ভাল খারাপের সীমানাটা তখন মুছে যায়, মুখ্য হয়ে উঠে একমাত্র পরিচয়- “আমরা সবাই জাপানি, আমার জাপানি ভাইয়ের জন্য আমি সবার আগে প্রাণ দেবো।” তাই তো যুগে যুগে পারমাণবিক বোমার আঘাত সহ নানা ভয়াবহ আক্রমণের ধাক্কা সইয়েও আজ জ্ঞানে-কল্যাণে-প্রযুক্তিতে সাফল্যের শীর্ষে ছোট্ট এই দেশটি, পৃথিবীবাসীর কাছে ভালবাসা এবং শ্রদ্ধামিশৃত বিস্ময়ের একটি নাম- জাপান!
লেখক -
জান্নাতুন ফেরদৌস সীমা
৩য় ব্যাচ, আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ
Comments
Post a Comment